‘আমিও চৌকিদার’ বলার জন্য যে রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে হয়

নরেন্দ্র মোদী যাঁদের দলে

জনাকয়েক রাঘব বোয়াল শিল্পপতি ছাড়া গোটা দেশের কেউই যখন ভাল নেই, চৌকিদাররাই বা খামকা ভাল থাকতে যাবেন কেন?

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share:

চৌকিদার নিয়ে যাবতীয় রসিকতা, মিম, পুরনো বিজ্ঞাপনের ভিডিয়োকে একেবারে নতুন অর্থে খুঁজে পাওয়া ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকেই কয়েকটা কম হাসির কথাও উঠে আসছে— সত্যিই যাঁরা চৌকিদার, তাঁরা কি এই পেশায় থাকতে চান আদৌ? আগের চেয়ে তাঁরা কি বিন্দুমাত্র ভাল আছেন? প্রধান চৌকিদারের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন ঘটলে তাঁদের ভাল থাকার সম্ভাবনা তৈরি হবে? অথবা, চৌকিদারের মতোই জীবন কাটান যাঁরা, তাঁদের?

Advertisement

এক অর্থে, প্রশ্নগুলো প্রশ্নই নয়— বাগ্‌ভঙ্গি মাত্র। জনাকয়েক রাঘব বোয়াল শিল্পপতি ছাড়া গোটা দেশের কেউই যখন ভাল নেই, চৌকিদাররাই বা খামকা ভাল থাকতে যাবেন কেন? যে পেশায় পদোন্নতি নেই, ক্যাজ়ুয়াল লিভ, আর্নড লিভ নেই, বছরের পর বছর কেটে যায় একটা টাকাও মাইনে না বেড়ে, অথচ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মালিকের দরজায় অতন্দ্র, সেই পেশায় কেউ থাকতে চাইবেনই বা কেন? এখন প্রশ্ন হল, ধর্ম থেকে জাতীয়তাবাদ, হরেক কিসিমের ধামাতে চাপা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা সত্ত্বেও দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের এই খারাপ থাকার কথাটা যখন কিছুতে লুকানো সম্ভব হচ্ছে না, ঠিক সেই সময়ই চৌকিদারের প্রসঙ্গ টেনে নরেন্দ্র মোদী এই খারাপ থাকাটাকে আরও স্পষ্ট করে দেওয়ার অবকাশ তৈরি করলেন কেন? রাজধর্মে মতি না-ই থাকুক, রাজনীতিতে তাঁর দখল নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। তবে কি তিনিও বুঝতে পারেননি যে চৌকিদারের সূত্র বেয়ে আরও অনেকের খারাপ থাকার কথা আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসতে পারে?

বুঝতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা যে একেবারে নেই, তা বলা মুশকিল। বিপৎকালে বুদ্ধিনাশ হওয়ার কথাটা তো নেহাত কথার কথা নয়। কিন্তু, শুধু সেটুকু বলেই ছেড়ে দিলে খণ্ডদর্শন হবে। বেশির ভাগ ভুলই অকারণে হয় না— দীর্ঘকালের অভ্যাস, বিশেষত ভাবনার অভ্যাস, মানুষকে দিয়ে ভুল করিয়ে নেয়। আঁচ করছি, নরেন্দ্র মোদী যখন চৌকিদারের কথা বলেছিলেন, তখন সত্যিকারের চৌকিদাররা তাঁর মনের কোণেও ঠাঁই পাননি। নরেন্দ্র মোদীর মাথায় ছিল একটা ধারণা— চৌকিদার এমন এক জন লোক, যিনি নিজের কথা না ভেবে মালিকের বিষয়আশয় রক্ষা করেন। নিজের কথা ভাবার অবকাশ তাঁর হয় না কেন, অথবা মালিকের মতো না হোক, অন্তত খানিক সম্পত্তি তাঁরও হবে না কেন কখনও, এই প্রশ্নগুলো প্রধানমন্ত্রীর মনে উঁকি দেয়নি। সমাজ মানে যে পটে আঁকা ছবিটি, যেখানে মধ্যবিত্ত গাড়ি কিনতে পারে, চৌকিদার মোবাইল ফোন, কিন্তু সামাজিক শ্রেণির রদবদল হয় না— এই ভাবনার অভ্যাসই তাঁকে দিয়ে ম্যায় ভি চৌকিদার বলিয়ে নিয়েছে বলে অনুমান করছি।

Advertisement

ভাবনার এই অভ্যাসটা কোথা থেকে এল, সেই প্রশ্ন একান্তই রাজনীতির। বস্তুত, আরএসএস-বিজেপির রাজনীতির। ভোটের তাগিদে নরেন্দ্র মোদী যতই দলিত-পিছড়ে বর্গদের কাছে টানার চেষ্টা করুন, যতই অম্বেডকরকে নিজের আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করুন আর পেমেন্ট ইন্টারফেসের নাম রাখুন ভীম, তাঁর দল চিরকালই ব্রাহ্মণ-বানিয়ার। উচ্চবর্ণের, উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের। রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা থেকে উনা-কাণ্ড, চন্দ্রশেখর আজাদকে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে রাখা থেকে অথবা শিডিউলড কাস্টস অ্যান্ড ট্রাইবস (প্রিভেনশন অব অ্যাট্রসিটিজ়) আইনের দাঁত-নখ ভোঁতা করে দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর চর্চিত নীরবতা, গত পাঁচ বছরে বহু বার প্রমাণ হয়েছে, বিজেপির কাছে নিম্নবর্গের গুরুত্ব ভোটের চেয়ে বেশি নয়। রাজনীতিতেও নয়, মনেও নয়। চৌকিদারের প্রসঙ্গে হঠাৎ করে দলিত-নিম্নবর্গের কথা এল কেন, তা ভেবে অবাক হওয়ার দরকার নেই— উচ্চবর্গের, উচ্চবর্ণের মানুষ চৌকিদার হন না। তাঁদের বাড়িতে চৌকিদার রাখার প্রয়োজন পড়ে। তাঁদের বাড়িতেই মালি কাজ করেন, গৃহপরিচারিকা থাকেন। আর, মূলত নিম্নবর্ণের মানুষরা নেহাত কম মাইনেয়, একান্ত সুযোগসুবিধাহীন সেই চাকরি করেন। বিকল্প নেই বলেই। নরেন্দ্র মোদীর দল মালিকের প্রতিনিধিত্ব করে, চৌকিদারের নয়। ফলে, মোদী যখন চৌকিদারের কথা বলেন, তখন তিনি কোনও রক্তমাংসের মানুষের কথা বলেন না। তিনি একটি ধারণার কথা বলেন— মালিকের চোখে চৌকিদারের ধারণা— যাঁর অস্তিত্বের একমাত্র কারণ মালিকের স্বার্থরক্ষা করা, মালিকের সম্পত্তিতে আঁচ লাগতে না দেওয়া।

আরএসএস-বিজেপি মুসলমানদের ঠিক কী চোখে দেখে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলা বাহুল্য। তবুও, তুলনায় মুসলমানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সরলতর। সেই সম্পর্ক বৈরীর। নিম্নবর্গের সঙ্গে সম্পর্কে জটিলতা বেশি। ব্রাহ্মণ-বানিয়ারা নিম্নবর্গকে যত হেনস্থাই করুন না কেন, আরএসএস দলিতদের তার বৃহৎ হিন্দুত্বের অংশ হিসেবেই দেখতে বা দেখাতে চায়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দলিতদের দলে টানতে চায়। এক অর্থে, এটা অসম্ভবের সাধনা। যেখানে দলিত রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মনুবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, সেখানে আরএসএস-এর মতো আন্তরিক ভাবে মনুবাদী দল দলিতদের টেনে আনতে চায় বৃহৎ হিন্দুত্বের ছাতায়। এই অসেতুসম্ভব দূরত্বকে সঙ্ঘ পরিবার যে ভাবে ঢাকতে চায়, নরেন্দ্র মোদীর চৌকিদার স্লোগানের শিকড় সেখানেই।

সঙ্ঘবাদীরা বই খুলে দেখিয়ে দেবেন, সাভারকর থেকে গোলওয়ালকর, কেউই অস্পৃশ্যতার সমর্থনে যুক্তি সাজাননি। যে কথাটা তাঁরা বলবেন না তা হল, বর্ণাশ্রম বস্তুটিকে মহিমান্বিত করতে পিছপা হননি সঙ্ঘের এই আদর্শগত পিতৃপুরুষরা। তাঁর বাঞ্চ অব থটস-এ গোলওয়ালকর স্পষ্ট জানিয়েছেন, প্রতিটি বর্ণের নির্দিষ্ট কাজ আছে, তাঁরা সেই কাজ করবেন— এটাই সমাজের ধর্ম। বর্ণাশ্রম নিজের জায়গায় থাকলে তার বাইরে থাকা দলিতরাও থাকেন উচ্চবর্ণের নির্দিষ্ট করে দেওয়া জায়গায়, অর্থাৎ বর্ণাশ্রমের এবং সমাজের বাইরে, প্রান্তে। এই কাঠামোটিকে বিন্দুমাত্র না ঘেঁটে দলিতদের বৃহৎ হিন্দুত্বের গল্পে টেনে আনার সম্ভবত একটাই পথ আছে— বলা যে, বর্ণাশ্রম যার জন্য যে কাজই নির্দিষ্ট করে থাকুক না কেন, তাতে কেউ বড় আর কেউ ছোট হয় না। হিন্দুত্বের ছাতার তলায় এক জনের সঙ্গে অপরের ফারাক নেই। আরএসএস ঠিক এটাই বলে। এবং, যে হেতু সব হিন্দুই সমান, ফলে নিম্নবর্গের জন্য সংরক্ষণেরও বিরোধী আরএসএস। ঐতিহাসিক বঞ্চনা ও তার ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গেই ঢুকতে নারাজ তারা। ভেবে দেখলে, উচ্চবর্গের জন্য চমৎকার ব্যবস্থা। যে যেখানে আছে, সেটাকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নিলে, তার মধ্যে অন্যায়ের খোঁজ না করলে, কাঠামোটা ভাঙার দাবি থাকে না আর। সেই কাঠামোতেও যে দলিতদের মধ্যে কেউ কেউ আগের থেকে ভাল থাকতে পারেন না, বা উচ্চবর্ণের কারও পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না তা নয়, কিন্তু সেগুলো সবই কাঠামোর ভিতর থেকেই সম্ভব, তার জন্য কাঠামো ভাঙার প্রয়োজন হয় না।

এই জায়গা থেকে দেখলে নরেন্দ্র মোদীর ‘আমিও চৌকিদার’ কথাটা অনেক জটিল মনে হয়। তাঁর মন অভ্যাসে জানে, মালিক আর চৌকিদারের অবস্থান অপরিবর্তনীয়। সেই কাঠামো ভাঙার রাজনীতি তাঁরা করেন না, করেননি কখনও। তিনি যে মালিকের প্রতিনিধিত্ব করেন, তা নিয়েও সংশয় নেই মনের। আর সবচেয়ে বেশি যেটা জানেন, তা হল, মাঝেমধ্যে নিজেকে চৌকিদার বললে ক্ষতি নেই— যত ক্ষণ অবধি কাঠামো অক্ষত থাকছে, মালিক আর চৌকিদারের জায়গা অদলবদল হবে না।

তবে, একটাই সংশয়। ভারত নামক দেশটার সিংহভাগ এখনও সঙ্ঘের পাঠশালার বাইরেই আছে। সেই ভারতে কেউ কাঠামো ভাঙার ডাক দেবে না, এতখানি নিশ্চিত হওয়া কি ঠিক হবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন