সম্পাদকীয় ১

অ-সভ্যতা

যাঁহাদের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে রহিয়াছে ‘আমরা-উহারা’র অমোঘ বিভাজন, তাঁহাদের নিকট রাজনৈতিক সৌজন্য আশা করা মুশকিল। সেই দলে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সত্য, তাপস পাল সত্য। কিন্তু, দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে যে ব্যক্তিগত সৌজন্য থাকে, তাহাও কি তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরা কালীঘাটে উৎসর্গ করিয়া আসিয়াছেন? সদ্যগঠিত শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়র অশোক ভট্টাচার্যের সহিত সুব্রত মুখোপাধ্যায় বা ফিরহাদ হাকিমের আচরণ দেখিলে সেই সন্দেহ হওয়া বিচিত্র নহে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share:

যাঁহাদের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে রহিয়াছে ‘আমরা-উহারা’র অমোঘ বিভাজন, তাঁহাদের নিকট রাজনৈতিক সৌজন্য আশা করা মুশকিল। সেই দলে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সত্য, তাপস পাল সত্য। কিন্তু, দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে যে ব্যক্তিগত সৌজন্য থাকে, তাহাও কি তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরা কালীঘাটে উৎসর্গ করিয়া আসিয়াছেন? সদ্যগঠিত শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়র অশোক ভট্টাচার্যের সহিত সুব্রত মুখোপাধ্যায় বা ফিরহাদ হাকিমের আচরণ দেখিলে সেই সন্দেহ হওয়া বিচিত্র নহে। দুই মন্ত্রীই জানাইয়াছেন, বিধানসভার অধিবেশন ছাড়িয়া তাঁহাদের পক্ষে অশোকবাবুকে সময় দেওয়া সম্ভব হয় নাই। অতএব, মহাকরণে অপেক্ষা করিবার পর তাঁহাকে ফিরিয়া যাইতে হইয়াছে। যদি বিধানসভায় মন্ত্রী এবং শাসকপক্ষের বিধায়কদের দীর্ঘ অনুপস্থিতির বাস্তবটি অজ্ঞাত থাকিত, তবে হয়তো এই দুই মন্ত্রীর সভার প্রতি দায়বদ্ধতার বাণী বেখাপ্পা এবং ফোঁপরা ঠেকিত না। বুঝিতে অসুবিধা হয় না, মন্ত্রিদ্বয়ের অজুহাতটি প্রকৃত প্রস্তাবে চক্ষুলজ্জার যেটুকু এখনও অবশিষ্ট আছে, তাহার ফল। ‘উনি সিপিআইএম, অতএব দেখা করিব না’, মুখ ফুটিয়া বলিতে এখনও বাধে। তবে অনুমান, ভবিষ্যতে তাঁহারা নির্দ্বিধায় বলিতে পারিবেন, ‘সিপিআইএম-এর সহিত কথা বলিলে দিদির গোঁসা হইবে।’ সৌজন্য আগে, না গর্দান?

Advertisement

এই অসৌজন্য তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্তর্গত। নেত্রী যখন যে দলকে নিজের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জ্ঞান করেন, দলের নেতা-উপনেতারা সেই দলের সহিত অসৌজন্যের প্রতিযোগিতায় নাম লেখান। গোড়ায় মূল শত্রু ছিল সিপিআইএম। অতএব, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকরা দলের কর্মীদের ডাকিয়া সিপিআইএম-এর কর্মী-সমর্থকদের সামাজিক ভাবে বয়কট করিবার হুকুম দিয়াছিলেন। গত লোকসভা নির্বাচনের মুখে কালীঘাটের শত্রু-কম্পাস বিজেপি-র দিকে ঘুরিয়া গেল। সর্বাধিনায়িকা বিমান বসুদের নবান্নে ফিশফ্রাই খাওয়াইলেন। এবং, রাজ্যের একমাত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে ‘হাফ-মন্ত্রী’ আখ্যা দিলেন নেত্রীর ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী। শিলিগুড়িতে বামফ্রন্টের হাতে পরাজিত হইবার পর বঙ্গেশ্বরীর সম্ভবত ফের সিপিআইএম-এর উপর গোঁসা হইয়াছে। অতএব, তাঁহার মন্ত্রীদের অশোক ভট্টাচার্যের সহিত কথা বলিবার সাহস হয় নাই। এই আচরণে অসৌজন্য প্রশ্নাতীত। তাহারও অধিক সেই অসৌজন্যের তুচ্ছতা। বিরোধী দলের এক প্রবীণ নেতাকে অপেক্ষা করাইয়া রাখিবার পর দেখা না করিবার মধ্যে যাহা আছে, তাহা খুচরা অসভ্যতা। কত নীচে নামিলে রাজ্যের শীর্ষস্তরের রাজনীতিকরা এমন কুঁদুলে আচরণ করিতে পারেন! মুখ্যমন্ত্রী ভুলিয়াছেন, কড়ে আঙুল দেখাইয়া আড়ি করা প্লে স্কুলে চলিতে পারে, নবান্নের শীর্ষে তাহা ভয়ানক বেমানান। অবশ্য, কোন্দলেই তাঁহার আনন্দ।

এই কোন্দল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছিল না। বিধানচন্দ্র রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, বিধানসভায় সংখ্যায় অকিঞ্চিৎকর বামপন্থীদের নেতা জ্যোতি বসুকে তিনি বক্তব্য পেশ করিবার জন্য বাড়তি সময় বরাদ্দ করিতেন। পরবর্তী কালে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ও জ্যোতি বসুর মধ্যেও ব্যক্তিগত সম্পর্কটি অক্ষুণ্ণ ছিল। ইন্দিরা গাঁধীর সহিত জ্যোতি বসুর সুসম্পর্কও সুবিদিত। সুব্রত মুখোপাধ্যায় দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিতে পারেন, সে সৌজন্য ইতিহাস। তাঁহার স্মরণে থাকিতে পারে, রাজ্যে বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতার মধ্যগগনে, তখনও তাঁহার সহিত বামপন্থী নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক তিক্ত ছিল না। কী ভাবে ব্যক্তিগত সৌজন্য বজায় রাখিয়াও রাজনৈতিক বিরোধে অবিলচিত থাকা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিখিতে পারেন। সৌজন্যের পাঠ লইলে তাঁহার রাজনীতির ধার কমিবে না।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন