সম্পাদকীয় ১

অতলস্পর্শী

শেষ কবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদ্বয়ের প্রাক্-নির্বাচনী বিতর্ককে কেন্দ্র করিয়া এই পরিমাণ উত্তেজনা দেখা গিয়াছে? এত বিপুলসংখ্যক মানুষ বিতর্ক শুনিবার জন্য আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করিয়াছেন?

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

শেষ কবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদ্বয়ের প্রাক্-নির্বাচনী বিতর্ককে কেন্দ্র করিয়া এই পরিমাণ উত্তেজনা দেখা গিয়াছে? এত বিপুলসংখ্যক মানুষ বিতর্ক শুনিবার জন্য আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করিয়াছেন? মার্কিন সমীক্ষামতে, ৩৬ বৎসর আগে। জিমি কার্টার ও রোনাল্ড রেগনের মধ্যে সেই ঐতিহাসিক বিতর্ক ১৯৮০ সালে দেখিয়াছিলেন (বা শুনিয়াছিলেন) ৮ কোটি ১০ লক্ষ জন। এ বার হিলারি ক্লিন্টন আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে তর্ক শুনিলেন অন্তত দশ কোটি। সাড়ে তিন দশকের মধ্যে টেলিকম বিপ্লব ঘটিয়া গিয়াছে, ফারাক হয়তো সেই পরিমাণে ভ্রু-উত্থান ঘটাইবার মতো নয়। তবু এই সাংখ্যিক হিসাব বলিয়া দেয় এ বারের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের ঘিরিয়া উত্তেজনার বহর। ২০১৬ সালের নির্বাচন মার্কিন দেশে সত্যই একটি গুরুতর ঘটনা হইতে চলিয়াছে। বিতর্কসভার পর ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারিও মনে করাইয়া দিলেন, মার্কিন জনসাধারণ এ বার বড় বাজি লইয়া মাঠে নামিতেছে। নির্বাচনের ফলাফল বলিয়া দিবে, মার্কিন সমাজ-সংস্কৃতির খোলনলিচা বেমালুম বদলাইতে বসিয়াছে কি না। ভাল-মন্দ বিচার-নিরপেক্ষ ভাবে বলা যায়, ট্রাম্প জয়ী হইলে পরিচিত আমেরিকার অনেক পরিবর্তন হইবার সম্ভাবনা। ইহা কেবল হিলারি ক্লিন্টনের অভিসন্ধিমূলক প্রচার নয়, সাদা বাস্তব।

Advertisement

এত নিম্নরুচির বিতর্ক মার্কিন জনসাধারণ তাঁহাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের কাছ হইতে আশা করিয়াছিলেন কি? যে ভাবে লাগাতার ডোনাল্ড ট্রাম্প আপত্তিকর ব্যক্তিগত আক্রমণ করিয়া গেলেন, তাহা মার্কিন ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাসেও অভাবনীয়। হিলারি অসুন্দর, হিলারি অকর্মণ্য, হিলারি মিথ্যাবাদী, ক্রমাগত এমন অভিযোগে ভরিয়া থাকিল তাঁহার বয়ান। বিপরীতে, অনিচ্ছাকৃত ভাবে হইলেও হিলারিকেও ব্যক্তিগত স্তরেই আলোচনা চালাইতে হইল, এক দিকে আত্ম-রক্ষণের জন্য, অন্য দিকে পাল্টা আক্রমণের খাতিরে। যে ট্রাম্প কর ফাঁকি দেন, তিনি কী ভাবে রাষ্ট্র চালনার দাবি উঠাইতে পারেন— হিলারির এই প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প যখন অমায়িক ভাবে বলিলেন যে তিনি চালাক বলিয়াই (কর ফাঁকি দেন), স্পষ্ট হইয়া যায় বর্তমান সময়ের মার্কিন রাজনীতির মানটি। বাস্তবিক, দশ কোটি মানুষ মনঃসংযোগ সহকারে এত নিম্নমানের দ্বিপাক্ষিক কথোপকথন শুনিয়াছেন কল্পনা করিলেও মার্কিন রাজনীতির ভবিষ্যৎ লইয়া উদ্বিগ্ন হইতে হয়। সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিদেশনীতি, সবই যে ব্যক্তিগত কুৎসার অতলে নামাইয়া আনা যায়, তাহার ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হইয়া রহিল এই বিতর্ক।

আর এক ভাবে দুই প্রার্থী শ্রোতাদের চূড়ান্ত হতাশ করিলেন। দুই জনের বাগ্মিতায় এত পার্থক্য যে পরস্পরের মধ্যে আদৌ কোনও অর্থপূর্ণ আলোচনা সম্ভব হইল না। ফলত, দুই জনের কাহারও নীতি বা আদর্শ বিষয়ে অর্থময় কোনও আন্দাজ পাওয়া গেল না। অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি লইয়া বলিষ্ঠ কিন্তু বেপরোয়া ট্রাম্প একের পর এক বায়বীয় দাবি করিয়া গেলেন, আর হিলারি তাঁহার সচিবসুলভ ভঙ্গিমায় ক্রমাগত অনাবশ্যক ডিটেল-কণ্টকিত বক্তব্যের ধোঁয়াশা রচনা করিলেন। ট্রাম্প বলিলে, তিনি নাগরিকের কাঁধ হইতে করের বোঝা এক কোপে নামাইয়া দিবেন। হিলারি বলিয়া চলিলেন তাঁহার শিশুকল্যাণ ও শস্তা কলেজশিক্ষার পরিকল্পনার ইতিকথা। ট্রাম্পের কথায় আবেগ টগবগে, কিন্তু বাস্তব-ভিত্তি শূন্য । হিলারি যথেষ্ট ‘পলিসি’মনস্ক অথচ যারপরনাই নিরাবেগ। ট্রাম্প-হিলারি বিতর্ক এই সত্য বুঝাইয়া দেয় যে, এই নির্বাচন মার্কিন জনসাধারণের পক্ষে দুরূহতমের পর্যায়ে পড়ে। তাঁহাদের সেই দুরূহ পরীক্ষার জন্য গোটা বিশ্বেই আপাতত উদ্বেগের প্রবাহ বহিতেছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন