রাজ্যপালদের পর এ বার বিভিন্ন সরকারি ও বিধিবদ্ধ কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকদের পালা। কেন্দ্রে নূতন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেই রাজ্যপালদের ইস্তফা দেওয়ার প্রশ্ন উঠিয়াছিল। পূর্বতন সরকার নিযুক্ত এই রাজ্যপালরা অধিকাংশই রাজনীতিক কিংবা অবসরপ্রাপ্ত আমলা। তাঁহাদের নিয়োগের পিছনে শাসক রাজনৈতিক দলের ‘কাছের লোক’ হওয়ার বিষয়টিই যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাইয়াছে, তাহাতে সংশয় নাই। ভারতীয় গণতন্ত্রে এটিই রেওয়াজ। আর তাই নূতন সরকার ক্ষমতাসীন হইলেই রাজ্যপালদের ইস্তফা দেওয়া উচিত। এই নিয়োগগুলি যেহেতু চরিত্রে ‘রাজনৈতিক’, প্রশাসনিক নয়, তাই নূতন সরকারকে তাহার নিজস্ব নীতি, কর্মসূচি ও এজেন্ডা রূপায়ণের সুযোগ দিতেই আগের সরকার নিযুক্ত ব্যক্তিদের ইস্তফা দেওয়া বিধেয়। ইহারই মধ্যে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ও বিধিবদ্ধ সংস্থার শীর্ষ আধিকারিকদের পদত্যাগের প্রশ্নটিও উঠিয়াছে। জাতীয় বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, মহিলা কমিশন, আইসিসিআর, তফশিলি জাতিদের জাতীয় কমিশন ইত্যাদির আধিকারিকদের ইস্তফা দিতে বলা হইয়াছে।
কেহ কেহ ইতিমধ্যেই ইস্তফা দিয়াছেন। অনেকেই টালবাহানা করিতেছেন। ইহাতে নূতন সরকারের কাজে অনাবশ্যক বিঘ্ন সৃষ্টি হইতেছে। নূতন সরকার তাহার নূতন নীতি ও কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য নূতন লোকও নিয়োগ করিবে, ইহাই স্বাভাবিক। ইউপিএ যখন ক্ষমতায় আসিয়াছিল, তখনও পূর্ববর্তী এনডিএ সরকারের নিয়োগগুলি বরবাদ করিয়া বিবিধ পদে নিজেদের লোক নিয়োগ করিয়াছিল। আগের নিযুক্ত আধিকারিক যোগ্য কি অযোগ্য, সর্বজনশ্রদ্ধেয়, নাকি সংকীর্ণ দলীয় পরিচিতিতে আবদ্ধ, তাহা এ ক্ষেত্রে বিচার্যই নয়। একমাত্র বিচার্য হইল জনাদেশ পাইয়া নূতন দিশায় দেশকে চালিত করার ভারপ্রাপ্ত রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের হাতে শাসন পরিচালনার পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব সঁপিয়া দেওয়া। সে জন্য পূর্বতন সরকার নিযুক্ত সকল আধিকারিকের পদত্যাগ জরুরি। নূতন সরকার মনে করিলে তাঁহাদের মধ্যে কাহাকেও পুনর্নিয়োগ করিতে পারে। কিন্তু তাহা করা বা না-করার এক্তিয়ার সম্পূর্ণত সেই সরকারেরই। ইহা লইয়া দলতন্ত্রের অভিযোগ তোলা অর্থহীন।
এই প্রক্রিয়ায় শূন্য হওয়া পদগুলিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কেহ কেহ ‘কলেজিয়াম’ গড়ার প্রস্তাব দিয়াছেন, যাহা ওই সব কেন্দ্রীয় কমিশনে, কমিটিতে, পর্ষদে নূতন করিয়া নিয়োগযোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করিবে এবং যাহাতে বিরোধী দলের সদস্যরাও উপস্থিত থাকিবেন। প্রস্তাবটি অহেতুক আমলাতান্ত্রিকতা ও দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি করিবে। তাই এই সব সংস্থার আধিকারিক নিয়োগ করা সরকারের প্রশাসনিক কর্তব্য এবং অধিকার। সরকারের দায়িত্ব ইহাই নিশ্চিত করা যে, এই সব সংস্থার পরিচালক মনোনয়ন যেন যথাযথ হয়। যোগ্যতাই যেন সেই মনোনয়নের মাপকাঠি হয়, আনুগত্য নহে। দীর্ঘ দিন যাবৎ রাজনীতিকরা, দলমতনির্বিশেষে, এই সুস্থ রীতিটি নষ্ট করিয়াছেন। মোদী সরকার তাহা ফিরাইয়া আনিতে পারিলে ভারতীয় গণতন্ত্রের মুখ উজ্জ্বল হইবে, মেরুদণ্ড দৃঢ়। কিন্তু তাহা সরকারেরই দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার নিশ্চয়ই বিরোধীদের সহিত কথা বলিতে পারে, নাগরিক সমাজের প্রাসঙ্গিক মহলের সহিতও আলোচনা করিতে পারে, তাহা সুস্থ দৃষ্টান্ত। কিন্তু নিজের কাজ ভাল ভাবে করিবার জন্য কলেজিয়াম বসাইবার প্রয়োজন নাই, যুক্তিও নাই।