বাজেট লইয়া দেশব্যাপী উত্তেজনা নিতান্তই তৃতীয় বিশ্বের বৈশিষ্ট্য। সরকারি আয়ব্যয়ের হিসাব পেশ করাকে কেন্দ্র করিয়া এমন আশা-আশঙ্কার দোলাচল, এমন তুঙ্গ উদ্দীপনার কোনও কারণ থাকিবার কথা নহে। তবুও থাকে, কারণ বাজেটের দিনই অর্থনীতির গতিপথ ঘোষণা করা অর্থমন্ত্রীদের অভ্যাসে দাঁড়াইয়া গিয়াছে। অরুণ জেটলির বাজেট সম্ভবত অনেককেই হতাশ করিবে। কারণ সংস্কারের পথে যে দৃঢ় পদক্ষেপের অঙ্গীকার তাঁহার বাজেটে প্রত্যাশিত ছিল, জেটলির বাজেট সেই স্তরে পৌঁছায় নাই। কেন, বোঝা কঠিন নহে। এই সরকার মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিন হইল ক্ষমতায় আসিয়াছে। ভারতীয় অর্থনীতি নামক মহাসাগরটির বিবিধ গভীরতা, ঢেউ এবং চোরাস্রোত বুঝিয়া লইবার পক্ষে সময়টি নিতান্তই কম। পিচের চরিত্র না বুঝিয়াই হাত খুলিয়া খেলিবার চেষ্টা তাহা অবিমৃশ্যকারিতা। জেটলি সম্ভবত জল মাপিবার সময় লইয়াছেন। এই সতর্কতার সমালোচনা অপ্রয়োজনীয়। এই বাজেটটিকে অন্তর্বর্তী বাজেট জ্ঞান করাই বিধেয়। বস্তুত, জেটলির বাজেটে সংস্কারের কিছু প্রত্যাশিত আভাস থাকিলেও তাহার গতিপথ মূল চরিত্রে পূর্বসূরির অনুবর্তী। রাজকোষ ঘাটতির হার হইতে রাজস্ব আদায়ের হার, বহু ক্ষেত্রেই জেটলি চিদম্বরমের ঘোষিত সংখ্যাগুলিকেই মান্য জ্ঞান করিয়াছেন। আয়করের হারও অপরিবর্তিত রাখিয়াছেন। স্পষ্টতই, এই বাজেটে খুব নূতন কিছু করিতে তাঁহার আগ্রহ ছিল না।
মুশকিল হইল, ভারতীয় অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য যে ‘তিক্ত বটিকা’ প্রয়োজন, সাবধানী হইয়া খেলিলে তাহার ব্যবস্থা করা যায় না। এবং, সেই কাজের জন্য সরকারের হাতে খুব বেশি সময়ও নাই। মুমূর্ষু রোগীর চিকিত্সা যেমন অনন্ত কাল ফেলিয়া রাখা যায় না, তেমনই নির্বাচনী সমীকরণের ক্ষেত্রেও এই তিক্ত বটিকা বিপজ্জনক। ফলে, নরেন্দ্র মোদীর হাতে খুব বেশি সময় নাই। এই বাজেটে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র এবং বিমায় ৪৯ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত আছে। সিদ্ধান্তটি প্রত্যাশিত ছিল তো বটেই, বাজার সেই প্রত্যাশাকে আত্মস্থও করিয়া লইয়াছিল। ফলে, এই ঘোষণায় সংস্কারের বল বেশি দূর গড়াইল না। সংস্কারের ক্ষেত্র প্রস্তুতই ছিল। কেন প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ভর্তুকি সংস্কার হইল না? হিসাব বলিতেছে, বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ১২ শতাংশের বেশি বাড়িয়াছে। খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি ইউপিএ জমানার ধারা বহন করিতেছে, পেট্রোলিয়াম ভর্তুকিতেও। কেন জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার অকুশলতা স্পষ্ট হইবার পরেও তাহার দায় বহন করা হইবে? বিলগ্নিকরণের প্রসঙ্গটিও বাজেটে নাই। পেনশন তহবিল বা খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগের প্রশ্নও কেন উত্তরহীন থাকিল? নমনীয় শ্রম আইনের প্রসঙ্গেও বাজেট নীরব। যে সরকার সংস্কারের অভিমুখে চলিতে চাহে, তাহার পক্ষে এত নীরবতা সুসংবাদ নহে।
কোন সংস্কার কত টাকার জোগাড় করিবে, তাহাতে রাজকোষ ঘাটতি কী পরিমাণ কমিবে বা বিদেশি বিনিয়োগ আসিবে কি না, এই প্রশ্নগুলি গৌণ। সরকারের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করিয়া দেওয়ার জন্যই এই সংস্কার জরুরি। কাহারও পেনশন তহবিলের হিসাব রাখা, কাহারও কাজের জোগাড় করিয়া দেওয়া আর কিছু শিল্পসংস্থা পরিচালনা যে সরকারের কাজ নহে, তাহা দ্ব্যর্থহীন ভাবে বুঝাইয়া দেওয়ার জন্যই এই সংস্কার প্রয়োজন। পুনর্বণ্টন নহে, দেশ যে উত্পাদন বৃদ্ধির পথে হাঁটিতেই মনস্থ করিয়াছে, এই কথাটিও বলিবার প্রয়োজন ছিল। কথাগুলি সুমিষ্ট নহে, ইহাই নরেন্দ্র মোদী-কথিত তিক্ত বটিকা। অরুণ জেটলি সম্ভবত সতর্কতার তাড়নাতেই এই দফায় এত দূর যান নাই। তাঁহার বাজেটের অভিমুখ সংস্কারের দিকে, তাহা অনস্বীকার্য। অতঃপর তিনি এবং তাঁহার প্রধানমন্ত্রী কত পথ হাঁটিতে পারেন, তাহাই দেখিবার।