সম্পাদকীয় ২

অবান্তর

যা হা না করিলেও চলে, ভারতে তাহাকেই বলে গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিজ্ঞপ্তি দিয়াছে, বেশি করিয়া ছাত্র পড়াইলে আর গবেষণার প্রয়োজন নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৬ ০০:০০
Share:

যা হা না করিলেও চলে, ভারতে তাহাকেই বলে গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিজ্ঞপ্তি দিয়াছে, বেশি করিয়া ছাত্র পড়াইলে আর গবেষণার প্রয়োজন নাই। অর্থাৎ ছাত্র পড়াইবার সহিত গবেষণা তুল্যমূল্য কাজ। নূতন জ্ঞানটি লাভ করিয়া গোটা বিশ্ব চমৎকৃত, সন্দেহ নাই। এত দিন ভাবা গিয়াছিল, নূতন জ্ঞান, নূতন উদ্ভাবন, নূতন দিকে চিন্তার প্রসার, ইহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষের প্রধান পরিমাপ, নিছক জ্ঞানস্পৃহা নহে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি হইতে শিল্প-বাণিজ্য, প্রশাসনের কৌশল হইতে উন্নয়নের নীতি, যে কোনও ক্ষেত্রেই গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তের প্রয়োগ হইতেই অগ্রগতি সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় সেই জ্ঞানচর্চার আঁতুড়ঘর। ভারতের পরম্পরা অন্যরূপ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শিক্ষক নিয়োগের শর্ত কিংবা পাঠ্যক্রমের খুঁটিনাটি লইয়া হুকুম জারি করিতে যত তৎপর, গবেষণা লইয়া মাথা ঘামাইতে তাহার সিকিভাগও আগ্রহী নহে। এ দেশে আজও বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি দানের লাইসেন্স-প্রাপ্ত কারখানা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিকট গবেষণা আজও একটি ‘ঐচ্ছিক বিষয়’, তাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কাজের মূল নিয়ন্ত্রক হিসাবে মর্যাদা পায় নাই।

Advertisement

সরকারও একই মানসিকতার শিকার। তৃতীয় বিশ্বের বহু দরিদ্রতর দেশের তুলনায় ভারতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য মাথাপিছু খরচ অনেক কম। তাহার ফলও ফলিয়াছে। একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, ভারতীয়দের গবেষণাপত্র অন্য দেশের গবেষকরা অতি সামান্য উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে প্রায় সকল দেশের পশ্চাতে ভারত। এ দেশে প্রায় সাত হাজার বিশ্ববিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষারত ছাত্রদের সংখ্যার নিরিখে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয়। তাহার পরেও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ব মানচিত্রে ভারতের এই দশা। ইহাতে যে দেশেরই ক্ষতি, সে বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁহার ভাষণে সতর্ক করিয়াছেন। ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকে অবহেলার ফলে একটি দুষ্টচক্র তৈরি হইয়াছে। উৎকৃষ্ট ভারতীয় গবেষকরা হয় বিদেশে যাইতেছেন, অথবা ভারতে কোনও গবেষণা সংস্থায় কাজ করিতেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রধানত দ্বিতীয় শ্রেণির গবেষকদের লইয়া চলিতেছে। তাহাতে গবেষণার মান নামিতেছে। বহু ক্ষেত্রেই গবেষণাপত্রের নামে যাহা প্রকাশিত হয়, তাহা বস্তুত গবেষণার ব্যঙ্গচিত্র। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার উদ্দেশ্য দুইটি: ছাত্রদের ডিগ্রি লাভ, শিক্ষকদের পদোন্নতি। গবেষণার প্রয়োগযোগ্যতা, তাহার তথ্যে বা বিশ্লেষণে নূতনত্ব, ইহার মূল্যায়ন কদাচিৎ হয়। এমন বিপুল পরিমাণে জঞ্জাল উৎপন্ন হইতেছে বলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিকট গবেষণা অকারণ কালপাত। বরং আরও কিছু ক্ষণ পড়াইলে ক্ষতি কী, ইহাই কমিশনের যুক্তি। কিন্তু যাঁহারা গবেষণায় আগ্রহী নহেন, তাঁহারা কেমন শিক্ষক? তাঁহারা কী পড়াইবেন? নিছক জীবিকার কথা মাথায় রাখিলেও তাহার উত্তর মেলে না। কারণ ভারতের স্নাতকদের এক-তৃতীয়াংশও নিয়োগযোগ্য নহে, বলিতেছে একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা। ইহাও লক্ষণীয় যে, কমিশনের বিজ্ঞপ্তিটি দেখিয়া শিক্ষক সংগঠনগুলি ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষোভ অধিক সময় পড়াইবার নির্দেশে। তাঁহাদের ঠান্ডা করিতে কেন্দ্র ইতিমধ্যেই সেই নির্দেশকে বাতিল করিয়াছে। কিন্তু গবেষণাকে ‘ঐচ্ছিক’ করিবার প্রশ্নে এখনও অবধি শিক্ষকদের আপত্তি শোনা যায় নাই। এই নীরবতাই ভারতে গবেষণার হাল বুঝাইতেছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন