কলিকাতা হাইকোর্টে আবার ধাক্কা খাইল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এ বার হাওড়া ময়দান হইতে রাজারহাট পর্যন্ত বিস্তৃত ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রেলের পথ লইয়া। ২০১২ সালে কেন্দ্রের ইউপিএ-২ সরকার হইতে ইস্তফা দেওয়ার পর অর্থাৎ সেই সরকারের রেল মন্ত্রক হাতছাড়া হওয়ার পর রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো হইতেও রাজ্য সরকারের অংশীদারি ছাড়িয়া দেয়। সেই সূত্রে নির্মীয়মাণ এই পাতাল রেলের পথ নূতন করিয়া বিন্যস্ত করার অধিকারও রাজ্য সরকারের থাকার কথা নয়। অথচ এত কাল শিয়ালদহ হইতে মহাকরণ পর্যন্ত পাতাল রেলের প্রস্তাবিত রুট পুনর্বিন্যাসের জেদ ধরিয়া রাজ্য নির্মাণের কাজে ব্যাঘাত ঘটাইয়াছে। হাইকোর্ট পত্রপাঠ সেই বাধা সরাইয়া অবিলম্বে পাতাল রেলের স্থগিত নির্মাণ পুনরারম্ভের নির্দেশ দিয়াছে। বিচারপতি নাদিরা পাথেরিয়া দ্ব্যর্থহীন তিরস্কারে রাজ্য সরকারকে জানাইয়াছেন, তাহার অন্যায় আব্দারের জন্য ইতিমধ্যেই বহু শত কোটি টাকার অপচয় হইয়াছে, আর নয়।
হাইকোর্টের নির্দেশ সঙ্গত। এমনিতেই গঙ্গার নীচে সুড়ঙ্গ কাটিয়া নদীর দুই তীরকে রেলপথে সংযুক্ত করার কাজটি দুরূহ, ব্যয়বহুল ও সময়সাধ্য। তদুপরি রাজ্য সরকারের জেদের কারণে সেই প্রকল্প বিলম্বিত হওয়া এবং ঘুর-পথে পাতাল রেল গড়িতে অতিরিক্ত বারোশো কোটি টাকা গুণাগার দেওয়া অর্থহীন। বিশেষত সরকারের তরফে যুক্তি যখন বউবাজার অঞ্চলকে পাশ কাটাইয়া সেখানকার হকার ও জবরদখলকারীদের স্বস্তি দেওয়া। জবরদখলকারীরা মহানগরীর অধিকাংশ অঞ্চলই বেআইনি ভাবে ব্যবহার করিতেছে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো দখল লইতেছে। তাহাদের খুশি রাখিয়া এই রাজধানী শহরে কোনও নগরোন্নয়ন প্রকল্পই রূপায়ণ করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল যখন কিছু মানুষের অসুবিধার কথা তোলেন, তখন এ জন্যই বিচারপতি অসংখ্য নিত্যযাত্রীর নিত্যযাত্রার নরকযন্ত্রণার পাল্টা যুক্তি দিয়া বলেন, কিছু সুবিধা ও লাভ পাইতে গেলে নাগরিকদের কিছু অসুবিধা ও কষ্ট তো সহ্য করিতেই হইবে। তুলনা টানিয়া বিচারপতির বক্তব্য— কোনও অবোধ শিশু আকাশের চাঁদকে হাতে আনিয়া দিতে বায়না করিতেই পারে, তাই বলিয়া কি বাস্তবে সেটা করা সম্ভব? বিচারপতির এই শ্লেষোক্তি যে রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকেই বিদ্ধ করিবে, তাহাতে সংশয় নাই। কিন্তু ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর রুট পুনর্বিন্যাসের পিছনে এ ধরনের শিশুসুলভ বায়না এবং জেদই সক্রিয় থাকিয়াছে।
একই ধরনের অবোধ জেদ ও বায়না কাজ করিয়াছে আদালতে বিচারাধীন বেশ কিছু মামলায়। সিঙ্গুরে সরকারের অধিগৃহীত এবং টাটা সংস্থাকে লিজ দেওয়া জমি ফেরত পাইতে রাজ্য সরকারের অর্ডিন্যান্স অনিচ্ছুক জমিদাতাদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দরদের সূচক হইতে পারে, কিন্তু দেশের আইন অনুযায়ী তাহা করা যায় কি? অনুব্রত মণ্ডলের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ‘শেষ পর্যন্ত’ যাইতে পারেন, কিন্তু তাহাতে পুলিশকে দিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে নথিভুক্ত খুনের অভিযোগ চার্জশিট হইতে বাদ দেওয়ানো যায় না। যত গরিষ্ঠতা লইয়াই কেহ ক্ষমতাসীন হোন, তাঁহাকে আইন মানিয়াই কাজ করিতে হইবে। আইনে কোনটা সিদ্ধ, আর কোনটা আটকায়, তাহা স্থির করার ভার আদালতের, নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের নয়। কোনও অজুহাত বা যুক্তিতেই আইনবিরুদ্ধ বা অসাংবিধানিক কোনও পদক্ষেপ কোনও জনপ্রিয় রাজনীতিক করিতে পারেন না। তিনি জয়রাম জয়ললিতা হউন কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।