২০১৪-উত্তর ভারতে অ্যান্টি-ন্যাশনালের বাড়া গাল নাই। কাহাকেও অ্যান্টি-ন্যাশনাল— বর্তমান প্রসঙ্গে ভারত-বিদ্বেষী— বলিয়া দাগাইয়া দিলে নাগরিক হিসাবে তাহার যে আর ‘বৈধতা’ থাকে না, নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে তাহাও প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে। যে ভারত-বিদ্বেষী, রাষ্ট্র তাহার সহিত যে কোনও আচরণ করিতে পারে। কে ভারত-বিদ্বেষী, তাহা চিহ্নিত করিবার প্রকল্পটি বর্তমান ভারতে পুরাদস্তুর রাজনৈতিক। অতএব, সেনাপ্রধান বিপিন রাবত যখন কাশ্মীরে দাঁড়াইয়া ঘোষণা করেন, কেহ পাকিস্তানের পতাকা উড়াইলে সেনাবাহিনী তাহাকে ভারত-বিদ্বেষী বলিয়া বিবেচনা করিবে, এবং শত্রুর সঙ্গে যে আচরণ বিধেয়, তাহার সঙ্গেও সেই আচরণই করা হইবে, তখন একাধিক স্তরে আপত্তি করা বিধেয়। প্রথমত, সেনাপ্রধান এত কথা বলিবেন কেন? জনসমক্ষে নিজের ‘মন কি বাত’ খোলসা করা ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্বধর্ম নহে। ভারতীয় সেনা একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, তাহার সেই চরিত্রটি রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। দ্বিতীয়ত, কে ভারত-বিদ্বেষী আর কে নহে, তাহা বিচার করা সেনাপ্রধানের কাজ নহে। সেনাবাহিনীর কাজের পরিধি সুনির্দিষ্ট এবং সেই গণ্ডিকে সম্পূর্ণ সম্মান করা সেনাপ্রধানের কর্তব্য। তিনি অনধিকারচর্চা করিলে তাঁহাকে সংযত করিবার দায়িত্ব সরকারের, শাসনবিভাগের। তৃতীয়ত, কোনও ভারতীয়র সহিত শত্রুর ন্যায় আচরণ করিবার অধিকার যে সেনাবাহিনীর নাই, সেই কথাটিও শ্রীরাবতকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। শত্রু বাছিবার অধিকার তাঁহার নাই— সেনাবাহিনীর কাজ বৈদেশিক আক্রমণ হইতে দেশকে রক্ষা করা। রাবত অনধিকারচর্চায় কালক্ষেপ না করিলেই ভাল করিবেন।
লক্ষণীয়, কেন্দ্রীয় সরকার সেনাপ্রধানকে তাঁহার এক্তিয়ারের কথাটি স্মরণ করাইয়া দেয় নাই। প্রধানমন্ত্রী কোনও প্রতিক্রিয়া জানান নাই। নীরবতা তাহার ধর্ম মানিয়াই বাঙ্ময় হইয়াছে। কেহ অনুমান করিতে পারেন, সেনাপ্রধানের কথাগুলি বিজেপির সুরের সহিত প্রতি স্বরে মিলিয়া গিয়াছে বলিয়াই সরকার চুপ। এক্ষণে কেহ বলিতে পারেন, বিপিন রাবত এই ভাবেই তাঁহার প্রথা-ভাঙা পদোন্নতির ঋণ চুকাইতেছেন। দুই অভিজ্ঞতর লেফটেনন্ট জেনারেলকে টপকাইয়া রাবতকে সেনাপ্রধান পদে বসানো হইয়া বিতর্কের স্মৃতি এখনও মিলাইয়া যায় নাই। রাবতের পদোন্নতিতে রাজনীতি ছিল কি না, আলোচ্য উক্তিটি তাঁহার ঋণ পরিশোধের পন্থা কি না, এই প্রশ্নগুলির উত্তর আপাতত অবান্তর। এমন অভিযোগ উঠিতে পারে, তাহাই যথেষ্ট উদ্বেগের। সেনাপ্রধান যদি বাক্সংযম অভ্যাস করিতেন, এই বিড়ম্বনা এড়ানো যাইত।
রাবতের অবাঞ্ছিত মন্তব্যে শাসক দলের নীরব সম্মতি বৃহত্তর উদ্বেগের কারণ। মোদীর জমানায় সেনাবাহিনীকে ক্রমে প্রশ্নাতীত উচ্চতায় স্থাপন করিবার চেষ্টা চলিয়াছে। দেশ এবং সেনাবাহিনীর রূপক দুইটিকে একে অন্যের উপর চাপাইয়া সেনাকেই ক্রমে দেশের মূর্ত প্রতীক করিয়া তোলা হইয়াছে। সধারণ্যের নিকট সেনার ‘পৌরুষ’-এর আবেদন চিরকালই গণতন্ত্রের তুলনায় বেশি। অনেকেই সম্ভবত ভাবেন, সেনার হাতে দেশের দায়িত্ব ছাড়িয়া দিলেই সব ঠিকঠাক চলিবে! সৌভাগ্য, ভারতকে সেই দিন দেখিতে হয় নাই। কারণ, নেহরুর আমল হইতেই সেনাবাহিনীকে কঠোর ভাবে অসমারিক নেতৃত্বের অধীন রাখা হইয়াছিল। অন্যথায় কী ফল হইতে পারিত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে স্বাধীন হওয়া বহু উপনিবেশে তাহার নজির রহিয়াছে। সেনাবাহিনীকে তাহার গণ্ডি অতিক্রম করিবার সুযোগ করিয়া দিয়া নরেন্দ্র মোদীরা আগুন লইয়া খেলিতেছেন। সেই আগুনে শুধু অশোক রোডের দফতর পুড়িবে না— তাহা ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোটিকে ভস্মীভূত করিয়া দিতে পারে। সাবধান হউন।