সম্পাদকীয় ১

আত্মঘাতের বন্দোবস্ত

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, তিনি দিল্লিতে জওহরলাল নেহরুর জয়ন্তী-উৎসবে যোগ দিয়াছিলেন বলিয়া বিজেপি বিদ্বেষবশত তাঁহার বিরুদ্ধতা করিতেছে। নেহরু-জয়ন্তী হইতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কী লইয়া ফিরিলেন, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু ‘নেহরু’ হইতে যে তিনি কিছুই শিখেন নাই, প্রতি দিন তাহার নবতর প্রমাণ মিলে। নেহরু বিশ্বাস করিতেন যে, গণতান্ত্রিক দেশের চালকবর্গের প্রধান কাজ, চালনার কাজটি প্রশ্নাতীত যোগ্যতা ও সহবত-সহকারে করা। নতুবা গণতন্ত্রের প্রধান শর্তটিই পূরণ করা অসম্ভব।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, তিনি দিল্লিতে জওহরলাল নেহরুর জয়ন্তী-উৎসবে যোগ দিয়াছিলেন বলিয়া বিজেপি বিদ্বেষবশত তাঁহার বিরুদ্ধতা করিতেছে। নেহরু-জয়ন্তী হইতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কী লইয়া ফিরিলেন, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু ‘নেহরু’ হইতে যে তিনি কিছুই শিখেন নাই, প্রতি দিন তাহার নবতর প্রমাণ মিলে। নেহরু বিশ্বাস করিতেন যে, গণতান্ত্রিক দেশের চালকবর্গের প্রধান কাজ, চালনার কাজটি প্রশ্নাতীত যোগ্যতা ও সহবত-সহকারে করা। নতুবা গণতন্ত্রের প্রধান শর্তটিই পূরণ করা অসম্ভব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যদের সম্পর্কে অভিযোগ তুলিবার আগে ভাবিয়া দেখিতে পারেন, যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যে তিনি নিজে একবিন্দুও বিশ্বাস রাখেন না, কেনই বা সেই ঐতিহ্য উদ্যাপন করিতে তিনি কষ্ট করিয়া দিল্লি গিয়াছিলেন। যে তীব্র দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং ততোধিক প্রবল রুচিহীনতার পরিচয় তিনি প্রত্যহ দিতেছেন, তাহাতে তাঁহার জনপ্রিয়তা কমিবে কি না, ইহাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন নয়। নিজের ব্যবহার দিয়া তিনি যে ভাবে দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মানটি টানিয়া ধুলায় নামাইতেছেন, তাহার অপেক্ষা বড় লজ্জা আর হইতে পারে না। তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন, জওহরলাল নেহরু, মোহনদাস কর্মচন্দ্ গাঁধী, বাবাসাহেব অম্বেডকর, ইঁহারা কেবল অর্থহীন ধ্বনিসমন্বিত কতগুলি নাম নহেন, মাল্যদানসুলভ অবয়ব নহেন। অনেক কষ্ট করিয়া তাঁহারা ভারতের রাজনীতির সংস্কৃতিটি তৈরি করিয়া দিয়াছেন। বিস্তীর্ণ দেশের বিপুল জনসমাজের কোথাও কেউ সেই সংস্কৃতির অপলাপ করিলেও করিতে পারেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের শীর্ষ পদটিতে আরূঢ় হইয়া সেই সংস্কৃতির উপর এহেন কশাঘাতের স্পর্ধা সম্পূর্ণ অমার্জনীয়।

Advertisement

সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রী যদি ভাবেন যে তাঁহার উচ্চারিত যে যে শব্দ ও বাক্যাংশের কারণে পশ্চিমবঙ্গ এখন অন্যতম প্রহসনের নাম, সেগুলি তো প্রকাশ্য জনসভায় তাঁহার অগণিত ভক্তবর্গের যথেষ্ট করতালি পাইয়াছে, তাই অন্যেরা কে কী বলে তাহাতে কী বা আসে যায়— তিনি ভুল ভাবিতেছেন। জনতা গণতন্ত্রের বাহক, কিন্তু জনতাই গণতন্ত্রের শুরু এবং শেষ নয়। গণতন্ত্রের নৈতিক ভিত্তি বলিয়া একটি কথা আছে, যাহার দিকে নেহরু ইঙ্গিত করিয়াছিলেন। সেই নৈতিক ভিত্তি হারাইয়া ফেলিলে যে গণতন্ত্রের শাসকের উপর কোন অপ্রত্যাশিত পথে প্রতিশোধ নামিয়া আসিতে পারে, তাহা মুখ্যমন্ত্রী মনে রাখিতেছেন না। গণতন্ত্র মানে নিম্নতার অভিমুখে অন্তহীন যাত্রা নয়, নিম্নতলকে উচ্চতর মানে উঠাইয়া আনিবার চেষ্টা। মুখ্যমন্ত্রী যদি নিম্নতার ফাঁদে নিজেকে আটকাইয়া ফেলেন, তাঁহার চরম বিপদ তিনি নিজেই, সরাসরি।

কেবল কুভাষার আ-সহবত নয়। ভাষা যে বক্তব্যের মোড়ক, সেই বক্তব্যের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাও দেখাইয়া দেয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেহরু-কথিত শাসনযোগ্যতার সার্টিফিকেট পাইতেন না। তিনি কেন সারদা-তদন্তের বিরোধিতায় উদ্বেল, তিনি নিজেই জানেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার সারদা-তদন্ত তৃণমূলের বিরুদ্ধে লেলাইয়া দিয়াছে, এই অভিযোগ অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন। তথ্য বলিতেছে, সারদা তদন্ত শুরু হইয়াছে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসিবার আগে। সিবিআই যে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন আজ্ঞাবহ সংস্থা-মাত্র, জনতার নিকট এই ভুল বার্তা পৌঁছাইয়াও মমতা ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি অন্যায় করিতেছেন। তিনি নিজেই বামফ্রন্ট আমলে কথায় কথায় ‘সিবিআই’ চাহিয়াছেন। যে পরিস্থিতিতে যাহা সুবিধা, রাজনীতি বলিতে তিনি তাহাই বোঝেন, নীতি, যুক্তি, এমনকী তথ্যেরও ধার ধারেন না। তাঁহার রাজনীতির মধ্যে যে আত্মঘাতের নিশানা প্রবল ও প্রত্যক্ষ, তাহা খেয়াল করাইয়া দিবার মতো সহকর্মীও তাঁহার দলে নাই। কে বলিতে পারে, গণতন্ত্রের প্রত্যাঘাত হয়তো এই পথেই উদ্যত!

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন