প্রবন্ধ ২

আবার সেই এক দাগিয়ে দেওয়ার খেলা

বামফ্রন্ট আমলে প্রতিবাদীদের গায়ে তৃণ-মাও তকমা লাগিয়ে দেওয়ার কৌশল দেখেছি। এখন তকমার নাম হয়েছে মাও-মাকু। তকমাটুকুই বদলেছে। পরিণাম ভেবে, আবারও, ভয় হয়। সুরবেক বিশ্বাসতখন ছিল তৃণ-মাও তক্মা। এখন মাও-মাকু। তখন তকমা পাওয়া এক পক্ষ ছিল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। এখন তারাই শাসক, অন্যের গায়ে তক্মা লাগিয়ে দেওয়ার অধিকারী। লালগড় আন্দোলনের স্মৃতিকে উস্কে দিচ্ছে যাদবপুর। শাসক শিবিরের বয়ানে সেই বহিরাগতের তত্ত্ব ও চক্রান্তের গন্ধের দাবি, নিরস্ত্র নারীর উপর পুলিশি প্রহারকেও ন্যায্য বলে প্রতিপন্ন করার সেই চেষ্টা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

তখন। পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে আদিবাসীরা। বর্ধমান, নভেম্বর ২০০৮।

তখন ছিল তৃণ-মাও তক্মা। এখন মাও-মাকু। তখন তকমা পাওয়া এক পক্ষ ছিল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল। এখন তারাই শাসক, অন্যের গায়ে তক্মা লাগিয়ে দেওয়ার অধিকারী। লালগড় আন্দোলনের স্মৃতিকে উস্কে দিচ্ছে যাদবপুর। শাসক শিবিরের বয়ানে সেই বহিরাগতের তত্ত্ব ও চক্রান্তের গন্ধের দাবি, নিরস্ত্র নারীর উপর পুলিশি প্রহারকেও ন্যায্য বলে প্রতিপন্ন করার সেই চেষ্টা।

Advertisement

২০০৮-এর ৫ নভেম্বর শেষ রাতে একদল সশস্ত্র পুলিশ লালগড়ের ছোটপেলিয়া গ্রামে হানা দিয়েছিল তিন দিন আগে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়কে লক্ষ করে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটানো মাওবাদীদের ধরতে। পুলিশের কাছে খবর ছিল, স্থানীয় মাওবাদীদের সঙ্গে বহিরাগত অতি-বাম নেতারা উপস্থিত ওই গ্রামে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে গ্রামের ঘরে ঘরে পুলিশি হানার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান গ্রামের আদিবাসী মহিলারা। তাঁদের কয়েক জন পুলিশের বন্দুকের কুঁদোর আঘাতে জখম হন বলে অভিযোগ ওঠে। মূলত আদিবাসী মহিলাদের উপর পুলিশি অত্যাচারের অভিযোগকে কেন্দ্র করেই পর দিন সকাল থেকে আন্দোলনে নামেন লালগড়ের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ।

পুলিশ-প্রশাসন-তদানীন্তন শাসক দলের মত ছিল, বিস্ফোরণের তদন্ত থেকে নজর ঘোরাতে মাওবাদীরাই গণ্ডগোল পাকাচ্ছে, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তৃণমূলিরা। লালগড়ের একটার পর একটা গ্রাম, তল্লাটকে তল্লাট এবং তার পর লালগড় ছাড়িয়ে জঙ্গলমহলের অন্যান্য এলাকার মানুষ আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন, নতুন নতুন এলাকা রোজ কার্যত প্রশাসনের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, তবু তৃণমূল-মাওবাদী আঁতাত ও চক্রান্তের তত্ত্ব আঁকড়ে ছিলেন সরকার পক্ষ ও শাসক দলের নেতারা। এবং ওই তত্ত্বকে যতই শক্ত করে আঁকড়ে ধরা হয়েছে, পরিস্থিতি ও এলাকার উপর থেকে নিয়ন্ত্রণের রাশ ততই আলগা হয়েছে প্রশাসনের।

Advertisement

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাত্রের অন্ধকারে তাণ্ডবের পরেও কলকাতার পুলিশ কমিশনার যেমন বলেছেন পুলিশ সংবেদনশীলতা ও ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করেছে, ছোটপেলিয়া গ্রামে পুলিশি বন্দুকের কুঁদোয় ছিতামুনি মুর্মুর বাঁ চোখ থেঁতলে যাওয়ার পরেও বামফ্রন্টের পুলিশ-প্রশাসন বলেছিল, পুলিশ যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। পুলিশ কমিশনারের দাবি, মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে বহিরাগতরা জড়ো হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, কিন্তু অত বড় পুলিশ বাহিনী সেই বহিরাগতদের কাউকে গ্রেফতার বা কোনও অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। ঠিক যেমন, ছোটপেলিয়া গ্রামে তাবড় মাওবাদী নেতারা লুকিয়ে ছিলেন বলে পুলিশ দাবি করেছিল, কিন্তু এক জনকেও ধরা যায়নি।

পর দিন, ৬ নভেম্বর সকালে লালগড়ে যাঁরা রাস্তা কেটেছিলেন, গাছ কেটে ফেলে রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাওবাদী ছিল না, তা নয়। কিন্তু রুষ্ট জনতার সবাই মোটেই মাওবাদী ছিল না। বলা যায়, মাওবাদীরা গোড়া থেকেই আন্দোলনকে কব্জা করতে পারেননি। সেই সকালে বহু মানুষ ঝাড়খণ্ড পার্টির সবুজ পতাকা কাঁধে অবরোধে শামিল হয়েছিলেন। অনেকে যোগ দিয়েছিলেন ধামসা-মাদল, তির-ধনুক, টাঙি নিয়ে। বহু মানুষেরই যোগদান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে। কোনও ‘বাদ’-এর কথা শুনে বা ভেবে তাঁরা যাননি। সেই সকালে ছত্রধর মাহাতো সিপিএম তথা বামফ্রন্ট বাদে বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীকে পাগলের মতো মোবাইল থেকে ফোন করে পাশে দাঁড়াতে কাতর অনুরোধ করছিলেন। মাওবাদীরা গোড়া থেকে নেতৃত্বে থাকলে তাঁরা ছত্রধর মাহাতোকে সেটা করতে দিতেন না।

তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল, যাদবপুরে মাওবাদীরা পিছন থেকে ছাত্রছাত্রীদের একাংশকে আন্দোলনের কৌশল বাতলে দিচ্ছেন। হতেই পারে, সিপিএম তথা বামফ্রন্টও খাস আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে প্রভাবিত করছে ছাত্রছাত্রীদের অন কোনও অংশকে। তা বলে সকলেই মাও-মাকু? সকলেই মঙ্গলবার রাতে ঘেরাও-আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন রাজনৈতিক রং থেকে? যে ছাত্রী ক্যাম্পাসের ভিতর শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন, তাঁকে সুবিচার পাইয়ে দেওয়া ও দোষীদের শাস্তির দাবি আসলে ভড়ং ছিল সকলেরই? তার পর ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ কি টেলিভিশন চ্যানেলে পুলিশের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর ঠ্যাঙানির ফুটেজ দেখে, সংবাদপত্রে খবর পড়ে, বন্ধুবান্ধবী বা সতীর্থদের কাছ থেকে খবর নেওয়ার পর ব্যক্তিগত আবেগ থেকে মুষলধারায় পড়া বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে শনিবারের মিছিলে পা মেলাননি? বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের পুলিশ ডেকে আনা মেনে নিতে না পেরেও অনেকে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন। তাঁরা সকলেই মাওবাদী কিংবা সিপিএম! এ তো ৯/১১-র অব্যবহিত পরে ২০০১-এর ২০ সেপ্টেম্বর আমেরিকার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ-এর সেই উক্তির মতো: হয় তুমি আমাদের সঙ্গে, নয়তো সন্ত্রাসবাদীদের দিকে!

আদিবাসী মহিলাদের উপর পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে লালগড় আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন এমন অনেকেই, যাঁদের সঙ্গে তখন মাওবাদ বা মাওবাদীদের সম্পর্ক ছিল না। তাঁরা তৃণমূলিও ছিলেন না। কিন্তু ক্রমাগত মাওবাদী বা তৃণ-মাও তক্মা দিয়ে তাঁদের চূড়ান্ত অসম্মান করেছিল বিগত শাসক দল ও প্রশাসন। ভেবেছিল, মাওবাদীরা বদমায়েশি করে এ সব করছে, আপনা থেকেই ঝামেলা থিতিয়ে যাবে, পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই। এবং প্রশাসনের এহেন চূড়ান্ত অবহেলার পর কোনও দিকেই না থাকা মানুষেরা আর সত্যিকারের ভাল মানুষ থাকতে পারলেন না। ঠিক সাত দিন পর মাওবাদীরা যখন আন্দোলনের রাশ হাতে নিল, গঠন করল ‘পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি’, ওই মানুষগুলোও যোগ দিলেন তাতে। কেউ সরাসরি, কেউ প্রচ্ছন্ন ভাবে। পরের ইতিহাস রক্ত, যন্ত্রণা আর অবক্ষয়ের।

যাদবপুরের ঘটনাপরম্পরা দেখে তাই একটা অন্য রকম ভয় হচ্ছে। এক জন না-মাও, না-মাকু পড়ুয়াকে বার বার মাও কিংবা মাকু বলার পরিণতি লালগড়ের মতো হবে না তো! এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই শহরের ছাত্রসমাজের একটা বড় অংশ সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থা না রেখে নৈরাজ্যের পথে হাঁটলে তার দায় কিন্তু সরকারেরই। লালগড়ের মতো। সরকার বলেই, তার কিছু বিশেষ এবং বাড়তি দায় থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন