সম্পাদকীয় ১

আর নাই রে বেলা

অভিমন্যু চক্রব্যূহ হইতে বাহির হইবার পথ চিনিতেন না। সেই না-জানা এই কিশোর-বীরকে মহাকাব্যিক অমরত্ব দিয়াছে। কিন্তু যাঁহাদের প্রস্থানের পথটি জানা, তাঁহারাও সর্বদা সেই পথ গ্রহণ করিতে পারেন কি? ধৃতরাষ্ট্র পারেন নাই। বানপ্রস্থের পথ সহজ হইয়াও কঠিন। সমগ্র সংসার যখন জানাইয়া দেয়, তোমার দিন ফুরাইয়াছে— তখনও নিজেকে সংসারের অংশ হিসাবে দেখিবার অলীক আকর্ষণ বানপ্রস্থের পথ রোধ করিতে থাকে। কথাটি লালকৃষ্ণ আডবাণী বিলক্ষণ জানিবেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৪ ০০:০৫
Share:

অভিমন্যু চক্রব্যূহ হইতে বাহির হইবার পথ চিনিতেন না। সেই না-জানা এই কিশোর-বীরকে মহাকাব্যিক অমরত্ব দিয়াছে। কিন্তু যাঁহাদের প্রস্থানের পথটি জানা, তাঁহারাও সর্বদা সেই পথ গ্রহণ করিতে পারেন কি? ধৃতরাষ্ট্র পারেন নাই। বানপ্রস্থের পথ সহজ হইয়াও কঠিন। সমগ্র সংসার যখন জানাইয়া দেয়, তোমার দিন ফুরাইয়াছে— তখনও নিজেকে সংসারের অংশ হিসাবে দেখিবার অলীক আকর্ষণ বানপ্রস্থের পথ রোধ করিতে থাকে। কথাটি লালকৃষ্ণ আডবাণী বিলক্ষণ জানিবেন। গত দেড় বৎসরে দল তাঁহাকে দ্ব্যর্থহীন ভঙ্গিতে জানাইয়াছে, আর তাঁহার প্রয়োজন নাই। বয়সও তাঁহার অনুকূল নহে। তবুও তিনি ছাড়িতে নারাজ। (রাজনৈতিক) সংসারে যে তাঁহার প্রয়োজন ফুরাইয়াছে, এই কথাটি মানিয়া লইতে তিনি সম্মত নহেন। আডবাণী একা নহেন, মুরলীমনোহর জোশী বা যশবন্ত সিন্হার ন্যায় নেতারাও যে কোনও মূল্যে সংসারেই ঠাঁই চাহেন। বানপ্রস্থের নিরাসক্তিতে তাঁহাদের রুচি নাই। তাঁহারা ভাবিয়া দেখিয়াছেন কি, যে সনাতন ভারতের পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন তাঁহাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রাণকেন্দ্রে, তাঁহাদের এই নাছোড় অবস্থান সেই আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী? সনাতন হিন্দু ভারত জানিত, ‘পঞ্চাশোর্ধ্বে বনং ব্রজেৎ’। ভাল হউক বা মন্দ, নূতনকে জায়গা ছাড়িয়া দেওয়াই সেই সংস্কৃতির নির্দেশ। আডবাণী বোধ করিতেই পারেন, নরেন্দ্র মোদী দলকে সম্পূর্ণ অন্য পথে লইয়া যাইবেন। এমন পথ, যাহা আডবাণীর নিকট অগ্রহণযোগ্য। যদি তাহাও হয়, তবু সেই গতি রোধ করিবার ভার আডবাণীর নহে। তাঁহার পর্ব ফুরাইয়াছে। এখন অনাসক্তিই বিধেয়।

Advertisement

যে রাজনীতিকরা সনাতন ভারতের আদর্শে তেমন অনুপ্রাণিত নহেন, বানপ্রস্থে অবশ্য তাঁহাদেরও সমান অনীহা। মহারাষ্ট্রে শরদ পওয়ার বা তামিলনাড়ুতে মুথুভেল করুণানিধি সাক্ষ্য দিবেন। বিহারে নীতীশ কুমার ব্যতিক্রম হইবার ইঙ্গিত দিয়াই ফের ক্ষমতার গদি ছুঁইয়া থাকিয়াছেন, অনুমান করা যায়, ২০১৫ সালের জনাদেশ যদি তাঁহাকে ফের শাসনের নৈতিক অধিকার দেয়, সেই আশায়। যাঁহার নিজস্ব রাজনৈতিক স্বীকৃতির গণ্ডি কখনও দিল্লির এ কে গোপালন ভবনের চৌহদ্দি অতিক্রম করে নাই, সেই প্রকাশ কারাটও একই পথের পথিক। তাঁহার বঙ্গজ কমরেডরাও। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হইতে বিমান বসু, বানপ্রস্থে কাহারও রুচি নাই। তাঁহারা ভাবিতে পারেন না, নূতন করিয়া দেওয়ার মতো আর কিছু তাঁহাদের নিকট অবশিষ্ট নাই। এখন সরিয়া দাঁড়ানোই শ্রেয়। তাঁহাদের যতটুকু করিবার ছিল, তাঁহারা করিয়াছেন, অথবা করেন নাই। কিন্তু নূতন করিয়া কিছু করিবার শক্তি তাঁহাদের আর নাই। এই অবস্থায় বানপ্রস্থের অনিবার্যতাকে অস্বীকার করিবার একমাত্র অর্থ নিজেকে আরও অপ্রাসঙ্গিক, অনাকাঙ্ক্ষিত, অপাঙ্ক্তেয় করিয়া ফেলা।

বানপ্রস্থের সময়টি মূলত বয়স দ্বারাই নির্দেশিত হয় বটে, কিন্তু তাহার বৃহত্তর দ্যোতনার পরিধি সুদূরপ্রসারী। সাধারণ ভাবে ধরিয়া লওয়া হয়, একটি নির্দিষ্ট বয়ঃক্রমের মধ্যেই যাহা করিবার, তাহা সাঙ্গ হইয়া যায়। কিন্তু, কাহারও কাহারও ক্ষেত্রে এমনও ঘটে যে, সেই বয়সে পৌঁছাইবার ঢের পূর্বেই বোঝা যায়, তাঁহার কিছুই দেওয়ার নাই। সাফল্য বা ব্যর্থতার যে অর্জন, সেই ঝুলি পূর্ণ। রাহুল গাঁধীরই যেমন। স্পষ্টতই কংগ্রেস অথবা ভারতীয় রাজনীতিকে নূতন কিছু দেওয়ার ক্ষমতা তাঁহার নাই। তিনি যাহা পারেন নাই, তাহা না-পারাই থাকিবে। বানপ্রস্থে যাওয়ার জন্য তাঁহার আর বয়সের অপেক্ষা করিবার প্রয়োজন নাই। তিনি লোটাকম্বল গুটাইলে কাহারও কোনও ক্ষতি নাই। ওয়ার্কিং কমিটি যতই তাঁহার পথ রোধ করিতে চাউক, তিনি মনের জোর সংগ্রহ করিয়া সেই বাধা অতিক্রম করুন। একা নহেন। সমাতৃক। তাহাতে দলের মঙ্গল হইবে। তাঁহারও।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement