সম্পাদকীয় ২

ইতিহাসের বিকৃতি

বর্তমানের যাঁহারা নিয়ামক, তাঁহারাই সচরাচর অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করেন, অন্তত নিয়ন্ত্রণ করিতে সচেষ্ট হন। তাই কোনও রাজনৈতিক দল শাসনক্ষমতা অর্জন করিয়াই নিজেদের আদর্শ ও নীতি অনুযায়ী কেবল ভবিষ্যতের কর্মসূচি প্রণয়ন নয়, অতীতের ইতিহাসকেও পুনর্লিখনে উদ্যোগী হয়। বিজেপি সরকার আসা ইস্তক অম্বেডকরকে লইয়া সেই প্রক্রিয়াই চলিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৫ ০০:১৮
Share:

বর্তমানের যাঁহারা নিয়ামক, তাঁহারাই সচরাচর অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করেন, অন্তত নিয়ন্ত্রণ করিতে সচেষ্ট হন। তাই কোনও রাজনৈতিক দল শাসনক্ষমতা অর্জন করিয়াই নিজেদের আদর্শ ও নীতি অনুযায়ী কেবল ভবিষ্যতের কর্মসূচি প্রণয়ন নয়, অতীতের ইতিহাসকেও পুনর্লিখনে উদ্যোগী হয়। বিজেপি সরকার আসা ইস্তক অম্বেডকরকে লইয়া সেই প্রক্রিয়াই চলিতেছে। কংগ্রেস যখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল, তখন দলিত মসিহা বাবাসাহেব অম্বেডকরকে তাহার নিজস্ব সংস্কৃতিতে আত্মস্থ করার চেষ্টা করিয়াছে। মহাত্মা গাঁধী ও কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সহিত দলিত-ক্ষমতায়নের প্রশ্নে অম্বেডকরের মৌলিক মতভেদ সত্ত্বেও তাঁহাকে পরবর্তী কালে কংগ্রেসের জাতীয় সংস্কৃতির অঙ্গীভূত করিয়া লইতে কোনও অসুবিধা হয় নাই। আর এখন কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সেই অম্বেডকরকেই একজন ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ রূপে তুলিয়া ধরার চেষ্টা শুরু হইয়াছে। সংঘ পরিবারের নেতৃত্ব বলিতে শুরু করিয়াছে, অম্বেডকর নাকি আরএসএসের মতাদর্শের সমর্থক ছিলেন। হিন্দু মহাসভার নেতা ও আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারের সহিত তাঁহার নিবিড় বন্ধুত্বের গল্পও প্রচারিত হইতেছে।

Advertisement

এই সব গল্প এবং গল্পমূলক ‘ইতিহাস’-এর উপলক্ষ ও লক্ষ্য: রাজনীতি। অম্বেডকরের ১২৫তম জন্মদিবস আজ। তাই কিছু দিন ধরিয়াই উত্তর ভারতের রাজনীতিতে দলিতদের নিজস্ব ‘আইকন’ হইয়া ওঠা অম্বেডকরের জন্মজয়ন্তী সাড়ম্বরে উদ্‌যাপনের যে বন্দোবস্ত, তাহার মধ্যেও রাজনীতির রমরমা। এই রাজনীতির যে সত্যাশ্রয়ী হইবার দায় নাই, বলাই বাহুল্য। দলিত হিসাবে তীব্র অস্পৃশ্যতার শিকার হইয়াও যে ব্যক্তি আপন প্রতিভা বলে উচ্চশিক্ষিত হইয়া সমগ্র দলিত সমাজের মুখপাত্র, নেতা ও সংগঠক হইয়া ওঠেন, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতিভেদপ্রথাকে ভাঙিবার প্রাণপণ চেষ্টায় ব্যর্থ হইয়া যিনি শেষ পর্যন্ত পাঁচ লক্ষ অনুগামীকে লইয়া বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন, তাঁহাকে আর যাহাই হউক, হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপাস্যলোকে উত্তীর্ণ করার প্রয়াসে সুস্পষ্ট প্রতারণা, এমনকী জালিয়াতি রহিয়াছে।

এই আদর্শ-জালিয়াতির রাজনীতি কেন জরুরি, বুঝিতে কষ্ট হয় না। সমগ্র হিন্দি বলয়েই দলিতরা এক নির্ণায়ক রাজনৈতিক শক্তি। তাঁহাদের ভোটের উপর উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, গুজরাতের অনেক আসনের জয়-পরাজয় নিষ্পন্ন হয়। এই দলিতদের অনেকেই বহুজনসমাজ পার্টির পতাকাতলে সমাবেশিত, অনেকেই নন। কিন্তু সকলেই অম্বেডকরকে তাঁহাদের পরিত্রাতা বলিয়া গণ্য করেন। দলিত নেত্রী মায়াবতী এক্ষণে দুর্বল, তাঁহার পরিষদীয় শক্তি হ্রাস পাইয়াছে। নূতন কোনও নেতা বা দল দলিতদের ত্রাতা হিসাবে উঠিয়া আসার আগে কিংবা বহুজনসমাজের পুনরুজ্জীবনের আগেই যদি অম্বেডকরকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী রূপে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে আগামী নির্বাচনগুলিতে দলিত ভোট লইয়া বিজেপিকে সংশয়ে থাকিতে হইবে না। ইতিমধ্যেই অনগ্রসর শ্রেণি হইতে রাজ্যে-রাজ্যে বহু নেতাকে দলের প্রাদেশিক নেতৃত্বে টানিয়া কমণ্ডলুর শিবির মণ্ডল কমিশনের অশ্বমেধের ঘোড়াকে থামাইয়া দিতে পারিয়াছে। এ বার দলিতদের পালা। এই অঙ্ক কষিয়াই বিজেপি কেবল উত্তরপ্রদেশে নয়, সারা দেশেই নূতন আইকনকে লইয়া এত তৎপর। হিন্দু জাতীয়তাবাদের অমর্ত্যলোকে অম্বেডকরের সাদর আমন্ত্রণ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন