সম্পাদকীয় ১

ইতিহাসমেধ যজ্ঞ

গণতন্ত্রের অর্থ যদি নানা মতামতের সমাহার-তথা-দ্বন্দ্ব হয়, তবে পাঠ্যপুস্তক যে সেই দ্বন্দ্বের প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র হইয়া উঠিবে, ইহা আর আশ্চর্য কী! তবে কিনা, কোন বক্তব্যটি ‘মতামত’ বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য, আর কোনটি নিছকই প্রলাপ, সেখানে সম্ভবত কিছু ভাবিবার বিষয় রহিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

গণতন্ত্রের অর্থ যদি নানা মতামতের সমাহার-তথা-দ্বন্দ্ব হয়, তবে পাঠ্যপুস্তক যে সেই দ্বন্দ্বের প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র হইয়া উঠিবে, ইহা আর আশ্চর্য কী! তবে কিনা, কোন বক্তব্যটি ‘মতামত’ বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য, আর কোনটি নিছকই প্রলাপ, সেখানে সম্ভবত কিছু ভাবিবার বিষয় রহিয়াছে। ‘শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস’-এর প্রেসিডেন্ট দীননাথ বাত্রা সম্প্রতি যে সব বক্তব্য প্রকাশ করিতেছেন, এবং ইতিমধ্যেই প্রকাশিত তাঁহার লেখা আটটি স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বইতে সবিস্তার ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা কত দূর ‘মতামত’ এবং কত দূর গোঁড়ামির বিস্ফোরণ? বিষয়টি গুরুতর, কেননা এই শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস সরাসরি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত, এবং ইতিমধ্যেই ‘শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলন’ নামক একটি এনজিও তৈরির মাধ্যমে দেশে শিক্ষার হাল পাল্টাইতে বদ্ধপরিকর। বাত্রা-রচিত পুস্তকগুলি অন্তত একটি রাজ্যে (গুজরাতে) বিদ্যালয় স্তরে চালু হইয়া গিয়াছে। রাজ্য সরকার সেগুলি অনুমোদন করিয়াছেন। এমনকী প্রধানমন্ত্রী মোদীরও স্বাক্ষর বইগুলির সূচনা-পৃষ্ঠা অলঙ্কৃত করিতেছে। বইয়ের ভিতরের পৃষ্ঠায় কী কী আছে? আছে প্রাচীন ভারতের ‘ইতিহাসে’ দেবতাদের আবির্ভাব ও দেব-দানবের যুদ্ধের কথা, কিংবা প্রাচীন রাজাদের মহাড়ম্বর গো-সেবা ও গো-আরাধনা প্রথার বিস্তারিত প্রশংসা, রামায়ণের ঐতিহাসিকতা প্রমাণের চেষ্টা ইত্যাদি। ভারতীয়ত্ব যে কোনও মতেই একটি মিশ্র সংস্কৃতি নহে, বরং দেব-নন্দিত ধর্ম-সিঞ্চিত একটি অটল ও অচল সভ্যতা, এই মৌলিক তথ্যটি ছাত্রছাত্রীদের মাথায় ঢুকাইবার বন্দোবস্ত। বাত্রা ও তাঁহার বিরাট সংখ্যক অনুসারীদের কাছে ইহা কেবল পাঠ্যপুস্তকের বিষয় নহে, তাঁহারা পাড়ায় পাড়ায় সেমিনার-ওয়ার্কশপ-সভা-মিছিলের মাধ্যমে ‘শিক্ষা বাঁচাইবার’ আন্দোলনটির প্রসার ঘটাইতে আগ্রহী।

Advertisement

বাত্রা ইতিহাস লিখিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহাকে ইতিহাসবিদ বলা চলে না। ইতিহাস এখন বাত্রা-গোত্রীয় ব্যক্তিদের কাছে এমনই একটি বিষয় যাহাতে গবেষণা কিংবা অধিকার কষ্ট করিয়া অর্জন করিবার দরকার নাই, মাতৃজঠর হইতে জাত হইয়াই প্রত্যেকের ইতিহাস-ভাবনা তৈরি হইয়া যায়। তাই তাঁহাদের বক্তব্যের প্রমাণ দিবার দায় অবশ্যই তাঁহাদের নয়। ইতিহাস তো চর্চাযোগ্য বিদ্যা নয়, রাজনীতির উপাদান-মাত্র। বাত্রা তাই বলেন, গৈরিকীকরণের অভিযোগে তিনি বিন্দুমাত্র আহত নহেন, বরং গর্বিত, গোটা দেশ গৈরিকীকৃত হইলে তবেই-না দেশের ভাবমূর্তি খুলিবে!

বাত্রারা যাহা বলিতেছেন, মোদী সরকার সেই পথেই শেষ পর্যন্ত চলিবে কি না, এখনও অস্পষ্ট। এন সি ই আর টি-র মধ্যেই গৈরিক রং ঢুকিয়াছে, কিন্তু এখনও তাহা পাকা নয়। বাস্তবিক, বাত্রাও চিন্তিত, সঙ্ঘাদর্শী ইতিহাসকে বিজেপি সরকার সম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা দিবে কি না সেই প্রশ্নে। মুশকিল হইল, এন সি ই আর টি-র মতো প্রতিষ্ঠানে তো গেরুয়া রং-ই প্রথম ঢুকিতেছে না, এত কাল অন্যান্য রাজনীতির রং-ও স্বল্পবিস্তর ঢুকিয়াছে বই কী! মার্ক্সীয় বা কংগ্রেসি ইতিহাস-রচয়িতাদের তো ভুলিয়া যাইবার উপায় নাই। ইতিহাসের রাজনীতি-করণের এই ট্র্যাডিশন স্বাধীন ভারতের বহু-পরিচিত। এবং এই কারণেই ভারতীয় ইতিহাস পাঠ্যপুস্তক কোনও কালেই পাতে দিবার যোগ্য নয় সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় তো বলিয়াছেন যে তাঁহার ছাত্রাবস্থায় স্মরণযোগ্য প্রতিটি ইতিহাস বইই ছিল বিদেশি লেখকদের রচনা! আজ বাত্রাদের থামাইতে হইলে তাই প্রথম কাজ: যথার্থ ইতিহাসবিদদের স্কুলপাঠ্য বই লিখিবার কাজে অগ্রসর হওয়া। তবে তাহাই যথেষ্ট নহে। অন্ধ রাজনীতির প্রকোপ থামাইতে সামাজিক লড়াইটি সর্বাধিক জরুরি। প্রচারমাধ্যমের চাপ, নিরন্তর নাগরিক ক্ষোভের উদ্গীরণ না হইলে রাজনীতির এই ইতিহাসমেধ থামানো যাইবে না।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন