ব্যালটের কাছে বুলেটের পরাজয়। গণতন্ত্রের কাছে সন্ত্রাসবাদের। জম্মু-কাশ্মীর ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফাকে এই ভাবে বিবৃত করিতে চাহিলে তাহাকে খুব একটা অতিশয়োক্তি বোধহয় বলা যাইবে না। দুই রাজ্যের নির্বাচনেই জঙ্গিরা বয়কটের আহ্বান বা হুকুমনামা জারি করিয়াছিল। অতীতে এই ধরনের নেতিবাচক অন্তর্ঘাতে সর্বদাই সশস্ত্র হামলার অনুষঙ্গ জড়িত থাকিত। কাশ্মীর উপত্যকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ও ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীরা ভোটদাতাদের সন্ত্রস্ত করিয়া ভোটদানে নিরস্ত করিতে তত্পর হইত। কাশ্মীর উপত্যকায় সর্বদলীয় হুরিয়ত সম্মেলন নামক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ছত্র-সংগঠন ভোট-বয়কটকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করিতে সিদ্ধহস্ত হইয়া উঠিয়াছিল। এ বারেও তাহাদের চেষ্টার ত্রুটি থাকে নাই। কিন্তু জনসাধারণ তাহাদের উপেক্ষা করার সুস্পষ্ট এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত লন। পরিণাম উভয় রাজ্যেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সোত্সাহ অংশগ্রহণ।
বস্তুত, কাশ্মীর উপত্যকার একদা উপদ্রুত কেন্দ্রগুলিতে মহিলাদের মধ্যেও দীর্ঘ সময় প্রবল শৈত্য উপেক্ষা করিয়া ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের লাইনে অপেক্ষা করার যে উদ্দীপনা লক্ষ করা গিয়াছে, তাহা বুঝাইয়া দেয়, সন্ত্রাস ও অরাজক অচলাবস্থার দিন পিছনে ফেলিয়া কাশ্মীরবাসী উপত্যকার ইতিহাস নূতন করিয়া লিখিতে চাহিতেছেন। তাঁহারা এখন রাজ্যের উন্নয়ন চাহেন। পরিকাঠামোর উন্নয়ন, শিল্পের, কৃষির উন্নয়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, বিদ্যুত্, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, পানীয় জল ও অত্যাবশ্যক পণ্যসামগ্রীর অব্যাহত সরবরাহ। আর এই সব কিছু সুনিশ্চিত করিতেই চাই একটি স্থিতিশীল, প্রতিনিধিত্বমূলক, দায়বদ্ধ সরকার। সীমান্তপারের জেহাদিরা যে উপত্যকার উন্নয়ন সাধনে অপারগ, এ কথা এত দিনে জনসাধারণ বুঝিয়া গিয়াছেন। তাই উত্তরোত্তর গণতান্ত্রিক শাসনপ্রণালীর প্রতি তাঁহাদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাইতেছে। লক্ষণীয়, জম্মু-কাশ্মীরে ভোটারদের অংশগ্রহণ ক্রমশই ঊর্ধ্বগামী। যে ১৫টি আসনে এ বার ভোট হইয়াছে, ২০০৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সেখানে ভোট পড়িয়াছিল ৬৫ শতাংশ, এ বার ৭১ শতাংশ। প্রবণতাটি স্পষ্ট। দেশের অনেক শান্তিপূর্ণ রাজ্যেও অনেক সময় এই পরিমাণ ভোটদাতা তাঁহাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করিতে আগাইয়া আসেন না। মাওবাদীদের বয়কটের আহ্বান অগ্রাহ্য করিয়া ছত্তীসগঢ়ের ১৩টি আসনেও ৬২ শতাংশ ভোটারের অংশগ্রহণ একটি উজ্জ্বল ইতিবাচক প্রবণতা। জঙ্গি মাওবাদকে সমাজ-পরিবর্তনের হাতিয়ার রূপে গ্রহণ করিতে রাজ্যবাসী যে প্রস্তুত নহেন, ইহা তাহারই প্রমাণ।
কাশ্মীরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এই সাফল্য পাকিস্তানের পক্ষে অস্বস্তিকর। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের জেহাদি তত্পরতাকে কাশ্মীরের ‘স্বাধীনতা-সংগ্রাম’ বলিয়া প্রচার করে, বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত নেতৃত্বকে কাশ্মীরি জনতার প্রকৃত প্রতিনিধি বলিয়া গণ্য করে। কাশ্মীরের জনসাধারণ কিন্তু দেখাইয়া দিতেছেন, হুরিয়ত নয়, তাঁহাদের নির্বাচিত বিধায়ক-সাংসদরাই তাঁহাদের প্রকৃত প্রতিনিধি। তাই হুরিয়ত নেতৃত্বের হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করার প্রবণতাও বাড়িতেছে। এমন নয় যে, কাশ্মীরে যে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হইবে, তাহাই রাজ্যে উন্নয়নের প্লাবন প্রবাহিত করিবে। কিন্তু তথাপি ভারতীয় প্রজাতন্ত্র হইতে রাজ্যের বিচ্ছিন্নতা নয়, বরং সেই প্রজাতন্ত্রের অঙ্গীভূত থাকিয়াই আর্থ-সামাজিক বিকাশ ও উন্নয়নের পথে পা ফেলার যৌক্তিকতা তাঁহাদের কাছে এত দিনে স্পষ্ট। পছন্দ করার স্বাধীনতা মঞ্জুর করিলে কাশ্মীর উপত্যকার জনগণ পরিষদীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুকূলেই মত দিবেন, পাক-সমর্থিত জঙ্গি সন্ত্রাস বা হুরিয়ত-পোষিত অগণতান্ত্রিক বিচ্ছিন্নতার পক্ষে নয়।