পাকিস্তানের প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ এবং প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ অসামরিক আদালতের কাঠগড়ায় বিচারাধীন। সেখানে দেশদ্রোহের অপরাধে তাঁহার বিচার শুরু হইয়াছে। ১৯৯৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাদখল করার পর সেনাপ্রধান মুশারফ ২০০৭ সালের নভেম্বরে দেশের সংবিধানকে সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় করিয়া দেন এবং বেশ কয়েকজন অপছন্দের বিচারপতিকে গ্রেফতারও করেন। দেশদ্রোহের মামলাটি সেই ঘটনার সূত্রেই। মুশারফ বেশ কিছু কাল যাবৎ নানা অজুহাতে আদালতের শমন এড়াইয়া চলিতেছিলেন। বিদেশে অসুস্থ মাকে দেখিতে যাওয়ার অছিলায় দেশত্যাগের পরিকল্পনাও করিতেছিলেন। বস্তুত, সেই মর্মে সোমবারও আদালতে তাঁহার আইনজীবীরা আর্জি জানান। কিন্তু আদালত তাঁহাকে অব্যাহতি দেয় নাই। পাকিস্তানের সমগ্র ইতিহাসে কোনও সামরিক শাসককে এ ভাবে আইনি বিচারের অধীন করার কোনও নজির নাই।
পাকিস্তানের ইতিহাসে দেখা গিয়াছে, জেনারেলরা সর্বদাই আইনের ঊর্ধ্বে। তাঁহারা অন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী জেনারেলদের ষড়যন্ত্রে কিংবা অভ্যুত্থানে অপসারিত কিংবা নিহত হইয়াছেন বটে, কিন্তু কখনও দেশের প্রচলিত আইনে বিচারাধীন হন নাই। কেন হন নাই, তাহা অনুমান করা সহজ। অসামরিক প্রশাসনের অর্থাৎ নির্বাচিত সরকার বা রাজনীতিকদের কখনও সাহসই হয় নাই জেনারেলদের বিচারের কাঠগড়ায় তোলার। জেনারেলরাই বরাবর নির্বাচিত অসামরিক রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে অপসারিত করিয়াছেন। তাহার পর নিষ্কণ্টক হইয়া দেশ শাসন করিয়াছেন তত দিন, যত দিন পর্যন্ত অন্য কোনও জেনারেল তাঁহাকে অপসারিত না করেন। পাকিস্তানে গণতন্ত্র যে এখনও সে ভাবে শিকড় গাড়িতে পারে নাই, তাহার কারণ সামরিক বাহিনীর সহিত তাহার সংঘাতে সর্বদা জেনারেলরাই জয়ী হইয়াছেন। তাই আজ বিচারবিভাগ এক ক্ষমতাচ্যুত জেনারেলকে দেশদ্রোহের দায়ে বিচারাধীন করার মধ্যে সেই ফৌজি প্রতিপত্তি ও আধিপত্য হ্রাস পাওয়ার কিছু লক্ষণ দেখা যাইতেছে, যাহা ফৌজিদের কাছে উদ্বেগজনক।
পাক সেনাবাহিনী তথা সামরিক কর্তৃপক্ষের জন্য তাই এই বিচার তত সুসমাচার নয়। দীর্ঘ কাল, বস্তুত গত সাড়ে ছয় দশক যাবৎ দেশের রাজনীতি ও সমাজে একচ্ছত্র প্রভাব খাটাইবার পর এই প্রতিপত্তি-হ্রাসের প্রবণতা মানিয়া লওয়া সহজ নয়। ধরিয়া লওয়া যায়, সামরিক বাহিনী গোটা বিচারপ্রক্রিয়াটিকে তত সুনজরে দেখিতেছে না। মুশারফ নিজেও নিশ্চয় ভাবিতেছেন, বাহিনীতে তাঁহার এক কালের সতীর্থ ও তরুণ জেনারেলরা তাঁহার সপক্ষে দাঁড়াইবেন। নিজেকে অন্য সকলের তুলনায় অধিকতর দেশপ্রেমী দাবি করিয়া একটি ব্যর্থ ইসলামি রাষ্ট্রকে প্রগতির পথে আগাইয়া দেওয়ার কৃতিত্বও তাঁহার সওয়ালে এ জন্যই উঠিয়া আসিয়াছে। তবে মুশারফের বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগও আছে—বেনজির ভুট্টোর হত্যা, বালুচিস্তানের বিদ্রোহী নেতাকে হত্যা, জঙ্গি ইসলামি ধর্মগুরুকে হত্যার দায়ও তাঁহার উপর বর্তাইয়াছে। পাক সামরিক বাহিনীর বর্তমান নেতৃত্ব যদি মুশারফের বিচারের মধ্যে অসামরিক রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হইয়া ওঠার ‘অশনি-সংকেত’ দেখিতে পান, তবে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবার বিলাসিতা তাঁহাদের পরিহার করিতে হইবে। এই বিচারের গতিবিধির উপর অনেকাংশে নির্ভর করিবে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।