সম্পাদকীয় ১

এবং গণতন্ত্র

ধর্মের কল অতীতেও বাতাসে নড়িত, এখনও নড়িতেছে। সামান্য তফাত: অতীতে তাহা নড়িত কেবল সিনেমার পর্দাতেই, অধুনা বাস্তবেও সুবাতাস লাগিয়াছে। ফ্যাশন হইতে বাগ্ভঙ্গি, বহু বিষয়েই বাস্তব চলচ্চিত্রের দুনিয়াকে অনুসরণ করিয়া থাকে, অপরাধ ও শাস্তির বিষয়েও তাহা ঘটিলে মঙ্গল। তামিল চলচ্চিত্রের ভূতপূর্ব নায়িকা ও তামিলনাড়ুর সদ্য-প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতা হয়তো সেলুলয়েডের কল্পলোক এবং ধুলার পৃথিবীর এই সমাপতনে মর্মাহত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

ধর্মের কল অতীতেও বাতাসে নড়িত, এখনও নড়িতেছে। সামান্য তফাত: অতীতে তাহা নড়িত কেবল সিনেমার পর্দাতেই, অধুনা বাস্তবেও সুবাতাস লাগিয়াছে। ফ্যাশন হইতে বাগ্ভঙ্গি, বহু বিষয়েই বাস্তব চলচ্চিত্রের দুনিয়াকে অনুসরণ করিয়া থাকে, অপরাধ ও শাস্তির বিষয়েও তাহা ঘটিলে মঙ্গল। তামিল চলচ্চিত্রের ভূতপূর্ব নায়িকা ও তামিলনাড়ুর সদ্য-প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম জয়ললিতা হয়তো সেলুলয়েডের কল্পলোক এবং ধুলার পৃথিবীর এই সমাপতনে মর্মাহত। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই স্মরণ করিতেছেন যে, মামলা এবং দণ্ডাদেশের মধ্যে প্রায় আঠারো বছর কাটিয়া গিয়াছে। বিচারের গতি দ্রুততর হইলে ধর্মের কল দ্রুত নড়িতে পারে। তবে এই মামলায় বাধা সৃষ্টির প্রভূত অভিযোগ এবং সেই বাধা অতিক্রম করিতে মামলা যে ভাবে চেন্নাই হইতে বেঙ্গালুরুতে স্থানান্তরিত করিতে হইয়াছে, তাহাতে মানিতেই হয়, আইন-আদালতের প্রতিষ্ঠানগুলি অনুকরণীয় দৃঢ়তার পরিচয় দিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী দুর্নীতি নিবারণ আইন মোতাবেক দণ্ডিত হইলেন, ইহার প্রতীকী তাৎপর্যও অনস্বীকার্য। ক্ষমতার উচ্চপদে থাকিয়া দুর্নীতি করিব এবং পার পাইয়া যাইব— এই নিশ্চিন্ততার অবসান ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও সম্ভাবনার সূচক।

Advertisement

অন্য সূচকও আছে। গত কয়েক বছরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশ জুড়িয়া যে প্রবল প্রতিবাদ এবং প্রতিকারের দাবি ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত, তাহাকে কোনও ভাবেই বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত চেতনা বলিয়া তুচ্ছ করিবার উপায় নাই। ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় দফায় দুর্নীতি গ্রিক উপকথার হাইড্রার মতো ভয়াবহ বহুমুণ্ড আকার ধারণ করিয়াছিল। জনমনে, অত্যন্ত সংগত কারণেই, এই বিশ্বাস উত্তরোত্তর প্রোথিত হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার হাইকমান্ড সেই অসুর দমনে তৎপর না হইয়া চোখ বুজিয়া থাকিয়াছেন। এই ধারণা যে তীব্র বিরাগ উৎপাদন করে, ইউপিএ তথা কংগ্রেসের অভূতপূর্ব নির্বাচনী বিপর্যয়ের পিছনে তাহার ভূমিকা বিপুল। ক্ষমতাবানের দুর্নীতির প্রতি নাগরিক সমাজের এই তীব্র ঘৃণা এবং প্রচলিত রাজনীতির পথে তাহা দূর করিবার বিষয়ে আস্থাহীনতাই আম আদমি পার্টির ধূমকেতু-উত্থান ঘটাইয়াছিল। অরবিন্দ কেজরীবালরা হাতের গদি পায়ে ঠেলিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের ব্যর্থতাই জানাইয়া দেয়, দুর্নীতির নাগপাশ হইতে মুক্তির জন্য নাগরিকরা এমনই মরিয়া যে, প্রশাসনিক সামর্থ্যের পরীক্ষা না লইয়াই তাঁহাদের হাতে রাজধানীর শাসনভার তুলিয়া দিয়াছিলেন।

সত্য বটে, বিহার হইতে উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু হইতে পশ্চিমবঙ্গ, সর্বত্রই আজও দুর্নীতির অভিযোগে আকণ্ঠ নিমজ্জিত দল এবং দলনেতারা বিপুল ভোটে জয়ী হইতেছেন। চার মাস পূর্বে লোকসভা নির্বাচনে তামিলনাড়ুর ঊনচল্লিশটি আসনের সাঁইত্রিশটি দখল করিয়াছিল এআইএডিএমকে। সারদা-আদি কেলেঙ্কারির সহিত পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের নিবিড় হইতে নিবিড়তর সংযোগের সাক্ষ্যপ্রমাণ জমিয়া উঠিলেও সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলিতে তাহার জনপ্রিয়তায় কোনও ভাটার টান দেখা যায় নাই। কোনও রাজ্যেই ভোটদাতারা বলেন নাই, ‘আগে সততা চাই, তাহার পর অন্য কথা।’ ভারতীয় গণতন্ত্রকে এখনও অনেক পথ হাঁটিতে হইবে। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্র তো নিরবচ্ছিন্ন ভাবে জঙ্গম। বলিষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন প্রশাসনের দাবিদার নরেন্দ্র মোদীকে তাঁহারও অভাবিত গরিষ্ঠতা দানের তিন মাসের মধ্যেই তাঁহার দলকে বিভিন্ন উপনির্বাচনে সমান অভাবিত ব্যর্থতা হজম করিতে হইয়াছে। স্পষ্টতই, নির্বাচকরা রাজনীতিকদের ক্রমাগত পরীক্ষা লইতেছেন। নিজেরাও শিখিতেছেন। আশা— তাঁহারা ক্রমশ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে দুর্নীতির মোকাবিলা করিতে শিখিবেন। ধর্মের কল নড়িতেই থাকিবে। আম্মার রাজ্যেও, দিদির রাজত্বেও।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement