ভারতীয় সেনাবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ ভারত-পাক কূটনীতিতে একটি নূতন মাত্রা যোগ করিল। যে ভাবে এই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর ঘোষণাটি করা হইয়াছে তাহা বুঝাইয়া দেয়, কূটনীতিই এই আক্রমণের একমাত্র বাধ্যতা নহে, রাজনীতির বাধ্যতাটিও সমধিক জরুরি। নতুবা এত তোড়জোড় করিয়া সরকারি বৈঠক ডাকিয়া ঘোষণাটি আসিত না। নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে যে ভারত এই প্রথম হানা চালাইল তাহা নয়। কিন্তু এই হানা রীতিমতো সুপ্রচারিত ও সুঘোষিত। উরির ঘটনার পর সামরিক প্রতিক্রিয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরাট চাপ তৈরি হইয়াছিল। সেই চাপের প্রেক্ষিতেই এই পদক্ষেপ। একই কারণে বিরোধীরা কোনও আপত্তি তো তোলেনই নাই, বরং সর্বদলীয় বৈঠকে প্রায় অভূতপূর্ব ভাবে শাসক দলের পাশে দাঁড়াইয়া পূর্ণ সমর্থন জানাইয়াছেন। ঘরের রাজনীতির চাপটি কত বেশি থাকিলে এই ঐকমত্য সম্ভব, তাহা বলিয়া দিতে হয় না। তবে ইহার অর্থ এই নয় যে রাজনৈতিক বাধ্যতাই একমাত্র উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের উপর কী ভাবে কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো যায়, গত কিছু দিন ধরিয়া তাহা ক্রমাগত দিল্লিকে উদ্বিগ্ন ও সক্রিয় রাখিয়াছে। পর পর বেশ কয়েকটি ঘোষণা শোনা গিয়াছে, নূতন কূটনৈতিক ব্যস্ততার ইঙ্গিত মিলিয়াছে। সিন্ধু জলচুক্তি পুনর্বিবেচনা, সার্ক বৈঠক বয়কট, সব মিলাইয়া দেখিলে বোঝা যায় পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের এই স্ট্রাইক কোনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নয়, বরং পাকিস্তানের উপর চাপ লাগাতার বাড়াইয়া কূটনীতিকে একটি অন্য স্তরে উঠাইয়া লওয়া। যুদ্ধই তো সামরিক পদক্ষেপের একমাত্র আকৃতি বা লক্ষ্য নয়। সীমিত সামরিকতা আসলে কূটনীতিরও বড় অস্ত্র, চিন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শিখাইয়াছে। ভারত যে সফল ভাবে সেই কৌশল শিখিতে পারিয়াছে, সাম্প্রতিক ঘটনা তাহার প্রমাণ।
তাহার আর একটি প্রমাণ ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে নিহিত। পাকিস্তান প্যাঁচে পড়িয়াছে: তাহার প্রতিক্রিয়া হইতে তাহা স্পষ্ট। প্রথমে পাল্টা হানার হুমকি এবং পরে আক্রমণ ও আক্রমণের কারণে ক্ষয়ক্ষতি অস্বীকার। ক্ষতি স্বীকার করিলে পাকিস্তানি পক্ষকে মানিয়া লইতে হয় যে, সীমিত অর্থে হইলেও ইহা সামরিক পরাজয়। মানিতে হয় যে পাক-অধিকৃত ভূখণ্ডে জঙ্গি শিবিরগুলি বিনা বাধায় অস্তিত্বশীল। অন্য দিকে, ক্ষতি হউক না হউক, ভারতের পদক্ষেপের আন্তর্জাতিক প্রচারের মধ্যে পাকিস্তানের নিজের ঘরোয়া রাজনীতির দিক হইতে যে এক রকমের বাধ্যতা তৈরি হয় সামরিক উত্তরের জন্য, তাহাও সহজবোধ্য। ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডি বিলক্ষণ জানে তেমন প্রত্যুত্তর সহজ নয়। সুতরাং তাহার একটিই উপায়, বিষয়টি যেন তেন প্রকারেণ চাপিয়া যাওয়া।
ভারতের পদক্ষেপকে এই জন্যও সফল বলিতে হইবে। হয় পাকিস্তান কোনও প্রত্যুত্তর দিবার চেষ্টা করিবে না, অথবা যে প্রত্যুত্তর দিবে তাহা ‘সামরিক’ পর্যায়ভুক্ত নয়। পাক নাগরিক সমাজ হইতে চাপের ক্ষেত্রে মনে রাখিতে হইবে যে রাওয়ালপিন্ডি কোনও কালেই জনমত মাপিয়া কাজ করে না, এ বারও করিবে এমন আশঙ্কা ভিত্তিহীন। মূল কথা, ভারতের আঘাতের তাৎক্ষণিক পাল্টা সীমান্তের ওপার হইতে আসে নাই, অন্তত প্রথম চব্বিশ ঘণ্টায়। এখনই কোনও নূতন সামরিক কার্যক্রম দিল্লি বিবেচনা করিতেছে না— সরকারের তরফে এই ঘোষণাটিও সুবিবেচিত। আক্রমণ কূটনীতির অন্যতম মাধ্যম হইতে পারে নিশ্চয়ই, কিন্তু বেশি বার ও বেশি দূর ইহার ব্যবহার ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। সর্বদলীয় বৈঠকে বিরোধী রাজনীতিকরাও বারংবার তাহা মনে করাইয়া দিয়াছেন। কোথায় থামিতে হইবে তাহা জানাও কিন্তু একাধারে সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ও সূচক।