দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রসপুঞ্জে কেন পুলিশের দেখা পাওয়া যাইতেছে না, সে প্রশ্নের উত্তরে কর্তারা যখন জানান যে পুলিশ দেখলেই স্থানীয় মানুষ আরও ক্ষিপ্ত হইতেছেন, তখন সেই কথাটিকে গুরুত্ব দেওয়াই বিধেয়। পুলিশের অপদার্থতার অজুহাত হিসাবে নহে, একটি তত্ত্বের প্রমাণ হিসাবে। বন্দুকের নল কখনও পুলিশের ক্ষমতার উৎস ছিল না। বস্তুত, অতি স্বল্প সংখ্যক নাগরিকেরই পুলিশের বলপ্রয়োগের মুখে পড়িবার, অথবা তাহা প্রত্যক্ষ করিবারও, অভিজ্ঞতা আছে। তবুও, ‘ক্ষমতা’-র তাত্ত্বিকরা বলিবেন, পুলিশের ক্ষমতা সর্বজনস্বীকৃত। পুলিশকে মান্য করাই সমাজের নিয়ম। তাহার মূল কারণ ভয় নহে— উর্দি পরিহিত আইনরক্ষকরা শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমন করেন, প্রয়োজনে কঠোর হওয়ার সামর্থ্য তাঁহাদের আছে, সমাজের অভিজ্ঞতালব্ধ এই বিশ্বাসই পুলিশকে তাহার বিশিষ্টতা প্রদান করে। এই বিশ্বাসই পুলিশের শক্তির মূলে। এই তত্ত্বের অনুসিদ্ধান্তটি রসপুঞ্জে প্রমাণিত হইতেছে— পুলিশ যখন স্বধর্মবিচ্যুত হয়, তখন তাহার সামাজিক মান্যতাও বিনষ্ট হয়, ক্ষমতা হাওয়ায় মিলাইয়া যায়। ফাঁড়িতে আগুন জ্বলিয়াছে, গ্রামবাসীরা পুলিশের পথ আটকাইয়া রাখিয়াছেন। যাহা মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্ন ছিল, পুলিশ সেখানেও প্রবেশাধিকার পায় নাই। নাগরিক পরিসরে যে বাহিনী রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রধানতম বাহক, তাহার এমন হতমান অবস্থা গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ হইতে পারে না। যে সমাজে পুলিশ কর্তৃত্বহীন, সেই সমাজ জঙ্গলের নিয়মে চলে— জোর যাহার, সেই সমাজের উপর নিয়ন্ত্রণও তাহার। পশ্চিমবঙ্গ প্রবল বেগে সেই দিকে ছুটিতেছে।
পুলিশকর্তারা বিলক্ষণ জানিবেন, কেন উর্দির দেখা পাইলেই স্থানীয় মানুষ আরও রাগিয়া যাইতেছেন। তাহার কারণ, পুলিশ আর কাল্লু মোল্লা মানুষের চেতনায় দুই বিপ্রতীপ প্রান্তের বাসিন্দা নহে, তাহারা কার্যত অবিচ্ছেদ্য। রসপুঞ্জে কাল্লু মোল্লার দাপাদাপি, অসভ্যতা এক দিনের ঘটনা নহে। পুলিশ সেই অন্যায় দমন করে নাই, কাল্লু মোল্লাকে শায়েস্তা করে নাই। মানুষ জানিয়াছে, কাল্লু মোল্লারা পুলিশের প্রশ্রয়েই নিরাপদ থাকে, দাপাইয়া বেড়ায়। কথাটি শুধু রসপুঞ্জের জন্যই সত্য নহে, পশ্চিমবঙ্গের কার্যত প্রতিটি প্রান্তে ইহাই বাস্তব। অতএব, কাল্লু মোল্লাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের যখন বিস্ফোরণ হয়, সেই আগুনে পুলিশ ফাঁড়িও জ্বলিয়া যায়। সত্যই কাল্লু মোল্লাদের অসামাজিক কর্মকাণ্ডে পুলিশের মদত ছিল কি না, সেই প্রশ্ন অবান্তর। মানুষের চোখে ইহাই সত্য। যেহেতু পুলিশের ক্ষমতা তাহাদের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিতেই টিকিয়া থাকে, ফলে পুলিশের নিকটও আপাতত ইহার বাড়া সত্য আর কিছু হইতে পারে না। কর্তারা কী ভঙ্গিতে এই সত্যটিকে অস্বীকার করিবেন, তাহাই দেখিবার।
কেন পুলিশ দুষ্কৃতীদের নিকট নতিস্বীকার করে, কেন সাধ্য থাকিলেও শিষ্টের পালনে সক্রিয় হয় না, এই প্রশ্নের একটি হাতেগরম উত্তর আছে— রাজনীতি। প্রকাশ্যে না হইলেও কর্তারা জনান্তিকে আফসোস করিয়াই থাকেন যে রাজনীতির চাপেই তাঁহাদের হাত গুটাইয়া থাকিতে হয়। চাপটি তাঁহারা স্বীকার করেন কেন, সেই প্রসঙ্গ আপাতত উহ্য থাকুক। তাঁহারা ভাবুন, নিষ্ক্রিয়তার কোন মূল্য বাহিনীকে দিতে হইতেছে। তাঁহাদের প্রতি যদি মানুষের বিশ্বাসটুকুই অবশিষ্ট না থাকে, সমাজ যদি তাঁহাদের সম্মান করিতে ভুলিয়া যায়, তবে আর বাহিনীর অস্তিত্বের প্রয়োজন কী? কেবলমাত্র বেতন (এবং, দুর্জনের মতে, উপরি) অর্জনই যদি এই পেশায় টিকিয়া থাকিবার একমাত্র কারণ হয়, তবে ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু পেশাগত সম্মানকে সামান্য গুরুত্ব দিলেও ঘুরিয়া দাঁড়াইবার সময় হইয়াছে। কাল্লু মোল্লারা যে নিতান্তই দমনযোগ্য, কথাটি অন্তত নিজেরা বিশ্বাস করিতে শিখুন।