করোটির হাস্য

নরকরোটি লইয়া দিল্লির রাস্তায় বসিয়াছেন তামিলনাড়ুর চাষিরা। প্রবল খরা তাঁহাদের যে বিপন্নতার অন্তিম প্রান্তে আনিয়াছে, দেশকে সেই বার্তা দিতে চান তাঁহারা। তীব্র খরার প্রকোপে সে রাজ্যের প্রতিটি জেলা ধুঁকিতেছে, কেবল ডিসেম্বর মাসেই শতাধিক চাষি আত্মহত্যা করিয়াছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৭ ০০:০৯
Share:

নরকরোটি লইয়া দিল্লির রাস্তায় বসিয়াছেন তামিলনাড়ুর চাষিরা। প্রবল খরা তাঁহাদের যে বিপন্নতার অন্তিম প্রান্তে আনিয়াছে, দেশকে সেই বার্তা দিতে চান তাঁহারা। তীব্র খরার প্রকোপে সে রাজ্যের প্রতিটি জেলা ধুঁকিতেছে, কেবল ডিসেম্বর মাসেই শতাধিক চাষি আত্মহত্যা করিয়াছেন। গত বর্ষায় বৃষ্টির অভাবে ফসল মাঠেই শুকাইয়াছে, ঋণ শোধের উপায় না দেখিয়া গত ছয় মাসে চার শত তামিল চাষি আত্মঘাতী হইয়াছেন বলিয়া দাবি। প্রতি দিনই নূতন নূতন মৃত্যুর সংবাদ ইঙ্গিত দিতেছে, সংকট দ্রুত কাটিবে না। রাজ্য সরকার জানুয়ারি মাসেই গোটা রাজ্যকে খরা কবলিত বলিয়া ঘোষণা করিয়াছে, এবং কেন্দ্রের নিকট দুর্যোগ-সহায়তা নিমিত্ত চল্লিশ হাজার কোটি টাকার জন্য আবেদন করিয়াছে। কিন্তু কেবল তামিলনাড়ুই নহে, গোটা দক্ষিণ ভারতই খরাগ্রস্ত। কর্নাটকও ইতিমধ্যে চার হাজার সাতশো কোটি টাকার সহায়তা দাবি করিয়াছে। কাবেরী নদীর জলাধারগুলি শূন্য হইবার দিকে। আসন্ন গ্রীষ্মে বেঙ্গালুরুতে পানীয় জলের অভাব হইতে পারে বলিয়া আশঙ্কা। কেরলের ইতিহাসেও তীব্রতম খরা চলিতেছে। সংকটের এই রূপ অপরিচিত নহে। ইহার পূর্বেই উত্তর ভারত ও গুজরাত খরাকবলিত হইয়াছিল। পানীয় জলের অভাবে মধ্যপ্রদেশের বহু গ্রাম জনশূন্য হইয়াছে। তিনটি রাজ্যের অনেক অঞ্চলে জলাধারে পুলিশ মোতায়েন করিতে হইয়াছিল, জলাশয়গুলির আশেপাশে জারি করা হইয়াছিল ১৪৪ ধারা।

Advertisement

সংকটের এই তীব্রতা কেবল মরসুমি বায়ুর বর্ষণের ব্যর্থতা নহে, ইহা সরকারি নীতি এবং পরিকল্পনার ব্যর্থতা। খরা হঠাৎ উপস্থিত হয় না, বহু পূর্বে আগাম বার্তা দিয়া আসে। আবহাওয়া দফতরের প্রযুক্তি এখন উন্নত। বর্ষণে বিলম্ব ও স্বল্পতা আগাম জানিবার কথা প্রশাসনের। নিদেনপক্ষে চাষিদের কথা শুনিলেও হয়। ভারতের এক-তৃতীয়াংশ বরাবর খরাক্রান্ত, আটষট্টি শতাংশ খরাপ্রবণ। দেড়শো বৎসর ধরিয়া খরার মোকাবিলা করিবার অভিজ্ঞতা রহিয়াছে প্রশাসনের। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি তীব্র খরার পর ‘খরাগ্রস্তের সহায়তা’ হইতে নীতির অবস্থান হইয়াছিল ‘খরা প্রতিরোধ।’ অনাবৃষ্টি, স্বল্পবৃষ্টি হইলেও জীবন-জীবিকার সংকট উপস্থিত না হয়, সেই পরিকল্পনা হইয়াছিল।

পরবর্তী ছয় দশকে জল সংরক্ষণের জন্য সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হইয়াছে। কেবল মহাত্মা গাঁধী গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের অধীনেই ভূগর্ভস্থ জলের স্তর বাড়াইতে, পুকুর খুঁড়িতে বিপুল অর্থব্যয় হইয়াছে। সরকারি হিসাব অনুসারে প্রতিটি গ্রামে গড়ে একুশটি পুকুর থাকিবার কথা, নানা প্রকারের বাঁধ সারা দেশে কয়েক কোটি নির্মিত হইয়া যাইবার কথা। খরাপ্রবণ এলাকার উপযুক্ত ফসল ফলাইবার প্রণালীতে চাষিকে প্রশিক্ষিত করিতেও খরচ কম হয় নাই। ফসল বিমাও থাকিবার কথা। এত প্রস্তুতি সত্ত্বেও এমন ধারাবাহিক ব্যর্থতা কেন? খরার সংকট এড়াইবার প্রকল্প থাকিতেও কেন কয়েকশো মানুষ আত্মঘাতী হইবেন, কয়েক কোটি পরিবার নামিবে দারিদ্র সীমার নীচে? কেন খরা প্রতিরোধে এত ব্যয়ের পরেও খরাগ্রস্তদের সহায়তায় রাজকোষ হইতে খরচ হইবে বিপুল অর্থ? দক্ষিণ ভারতের খরা বুঝাইল, নীতি লইয়া ছেলেখেলার কী পরিণাম হইতে পারে। ত্রুটিপূর্ণ নীতি, ব্যর্থ রূপায়ণের ফল দিল্লির পথের নরকরোটি।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন