সম্পাদকীয় ১

কর্ত্রীর ইচ্ছায়

রাজ্যের নির্বাচন কমিশন আইনের ধারায় কর্মরত আমলাকে অস্থায়ী কমিশনার রূপে নিয়োগ করিবার ব্যবস্থা আছে, অতএব করিব— এই মানসিকতায় যে বস্তুটির অভাব প্রকট, তাহার নাম ঔচিত্যবোধ। কোন কাজটি করা উচিত, আর কোনটি নৈতিকতার গণ্ডিতে ঠেকিয়া যায় বলিয়াই করা অনুচিত, এই বোধটির স্থান আইনের ঊর্ধ্বে। বস্তুত, কোনও আইন আদৌ ব্যবহার্য কি না, তাহা স্থির করিবার মাপকাঠি এই ঔচিত্যবোধ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

রাজ্যের নির্বাচন কমিশন আইনের ধারায় কর্মরত আমলাকে অস্থায়ী কমিশনার রূপে নিয়োগ করিবার ব্যবস্থা আছে, অতএব করিব— এই মানসিকতায় যে বস্তুটির অভাব প্রকট, তাহার নাম ঔচিত্যবোধ। কোন কাজটি করা উচিত, আর কোনটি নৈতিকতার গণ্ডিতে ঠেকিয়া যায় বলিয়াই করা অনুচিত, এই বোধটির স্থান আইনের ঊর্ধ্বে। বস্তুত, কোনও আইন আদৌ ব্যবহার্য কি না, তাহা স্থির করিবার মাপকাঠি এই ঔচিত্যবোধ। বিশেষত ভারতের ন্যায় দেশে, যেখানে বিচিত্র আইনের কোনও অভাব নাই। ১৯৩৪ সালের এয়ারক্র্যাফ্ট অ্যাক্ট-এর মতে, ঘুড়িও এক প্রকার নভোযান। অতএব, ঘুড়ি উড়াইবার পূর্বে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাবিধি অনুমতি না লইলে পুলিশ ‘অপরাধী’কে বিলক্ষণ হাজতে পুরিতে পারে। অথবা, ১৮৭৮ সালের ইন্ডিয়ান ট্রেজার ট্রোভ অ্যাক্ট অনুযায়ী, পথেঘাটে দশ টাকার বেশি কুড়াইয়া পাইলে তাহা জেলাশাসকের দফতরে জমা দিতে হইবে। না দিলে? পেয়াদা আসিয়া পাকড়াইয়া ধরিতে পারে। আইনগুলি আছে, কিন্তু কেহ তাহা ব্যবহারের কথা ভাবিতেও পারেন না। সম্ভবত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নহেন। তিনিও নিশ্চয় জানেন যে, কিছু কিছু আইনকে ভুলিয়া থাকাই উচিত। তবুও যখন তিনি আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়োগকে বৈধতা দিতে এক বিচিত্র আইনের ফোকর খুঁজিলেন, তখন বোঝা যায়, তিনি আইনের ঢাল খাড়া করিয়া নিজের ইচ্ছা পূরণ করিতেছেন।

Advertisement

যেমন করিয়াছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। ১৯৭৫ সালে। জরুরি অবস্থা জারি করিবার জন্য তাঁহাকে আইন প্রণয়ন করিতে হয় নাই। ভারতীয় সংবিধানে সেই আইন ছিলই। তিনি শুধু উপদেষ্টাদের বুদ্ধি লইয়া নিজের রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণ করিতে সেই আইন ব্যবহার করিয়াছিলেন। আজ নবান্ন হইতে আলাপনবাবুর নিয়োগের পক্ষে যে যুক্তি খাড়া করা হইতেছে, জরুরি অবস্থার সমর্থকরাও ইন্দিরার পক্ষে সেই যুক্তিই দিয়াছিলেন— আইন যখন আছে, তখন তাহার ব্যবহার অন্যায় নহে। যে কারণে ইন্দিরার যুক্তি ধোপে টেকে নাই, ঠিক সেই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তিও টিকিবে না। কারণ, নৈতিকতার স্থান আইনের ঊর্ধ্বে। জরুরি অবস্থা যেমন আইনসিদ্ধ হইলেও অন্যায়, অনৈতিক, অস্থায়ী নির্বাচন কমিশনার হিসাবে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিযুক্তিও সমান অন্যায়, সমান অনৈতিক। কোনও শাকেই আঁশ ঢাকা পড়িবে না। বামফ্রন্ট এই বিচিত্র আইনটি রচনা করিয়াছিল, কারণ গণতন্ত্রের ভিতর অন্তর্ঘাতসাধন বামপন্থীদের চরিত্রলক্ষণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই আইনকেই নিজের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহার করিলেন। তাঁহার হাতে গণতন্ত্র আরও এক দফা লাঞ্ছিত হইল।

গণতন্ত্রের সম্মানরক্ষা অবশ্য কখনও তাঁহার কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল না। আজিকার পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকাইলে সে বিষয়ে আর সন্দেহ থাকে না। তাঁহার রাজত্ব একটিই নীতির উপর চলে: তাঁহার ইচ্ছাই আইন, তাঁহার ইচ্ছাই নীতি। তিনি চাহিলে হাজার দাবি সত্ত্বেও দীর্ঘ এক বৎসর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইনটিকে সরকার ভুলিয়া থাকিতে পারে, তাহার পর সেই আইন মুছিয়া ফেলা হয়। আবার, তিনি চাহিলে একটি নির্দোষ ব্যঙ্গচিত্র প্রেরণের অপরাধেও পুলিশ বিচিত্র সব ধারায় মামলা সাজাইতে পারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় আইন, যাবতীয় নীতির সুতা বাঁধা। তিনি তাঁহার ইচ্ছানুসারে সেই আইনগুলিকে নাচান। তাহাতে নৈতিকতার সম্মান থাকিল কি না, ঔচিত্যের কী হইল, এই প্রশ্নগুলি নিতান্ত অবান্তর। একনায়িকার রাজ্যে কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম। এখনও যে আইনের ফাঁকের ডুমুরপাতায় লজ্জা নিবারণের একটা চেষ্টা চলিতেছে, তাহাই বোধ হয় এই স্বৈরতন্ত্রে যথেষ্ট।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন