খারপ হোক বা ভাল, ভাবমূর্তি বদলাতে নারাজ নেতারা

নিজেদের সৃষ্ট মিথের হাতে বন্দি হয়ে যান রাজনৈতিক নেতারা। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।নিজেদের সৃষ্ট মিথের হাতে বন্দি হয়ে যান রাজনৈতিক নেতারা। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০৯:৫৩
Share:

স্তালিন

বার্টার্ন্ড রাসেল ১৯৫৪ সালে এক মজার তীর্যক কল্পকাহিনি লেখেন। বইটির নাম ‘নাইটমের্য়ার্স অফ এমিনেন্ট পারসন্স’। এই রাজনৈতিক ফ্যান্টাসিতে এক একটি রাজনৈতিক বা সামাজিক চরিত্র সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে পারসেপশন তাতেই সজোরে আঘাত আনা হল।

Advertisement

বইটিতে নানা বিখ্যাত মানুষের কল্পিত দুঃস্বপ্ন ছিল। স্তালিন, শোবোনহাওয়ার এবং আরও চরিত্র।

স্তালিনের দুঃস্বপ্ন নামক আখ্যানে দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর আগে লাল মরিচ মেশানো বড়সড় এক গ্লাস ভদকা গলায় ঢেলে স্তালিন তাঁর চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমোতে ঘুমোতে তিনি দেখলেন যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গিয়েছে এবং তিনি হেরে গিয়েছেন। পশ্চিম মিত্রশক্তির হাতে তিনি এখন বন্দি। নবনিযুক্ত এক কমিটি ঠিক করেছে ভালবাসার শক্তি দিয়ে বন্দি স্তালিনের মধ্যে অনুশোচনা জাগিয়ে তোলা হবে। তাই এক অজপাড়াগাঁয়ে এক ছোট্ট বাড়িতে স্তালিনকে বন্দি রেখে তাঁকে নিয়মিত বাইবেল, পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস বা আংকল টমস কেবিন পড়ানো হচ্ছে। ধূমপান বা লাল মরিচ শুদ্ধ ভদকা পান নিষিদ্ধ।

Advertisement

সকাল-সন্ধ্যায় এক ঘণ্টা করে কিছু গম্ভীর লোক স্তালিনকে বোঝান যিশুখ্রিস্টের বদান্যতা। এমনকী, কী ভাবে তাঁর মোক্ষলাভ হতে পারে। তাঁরা স্তালিনকে বোঝান, আপনি ভুল পথে হেঁটেছেন। আপনার সম্পর্কে মানুষের ধারণা, আপনি খুনি। একনায়কতন্ত্রী এই ধারণা আজ আপনি নিজেই ভেঙে ফেলুন। স্তালিন চিৎকার করে ওঠেন: আপনারা আমাকে কি খ্রিস্টীয় প্রেম শেখাচ্ছেন? মানুষ আপনাকে ঘৃণা করছে,কিন্তু সে কথা মুখ ফুটে বলার সাহস নেই কারও— এ ঘটনায় কী অনির্বচনীয় আনন্দ আছে তা আপনারা কী বুঝবেন!

স্তালিনকে ভদকার বদলে কোক দেওয়া হচ্ছে। এই পানীয় না কি তাঁর মাথা ঠান্ডা করবে। দুঃস্বপ্নের মধ্যে এক সময় ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটছে স্তালিনের। তিনি মারমুখী হয়ে উঠছেন। নিজের পারসেপশন তিনি ভাঙতে চান না। আর তখনই স্তালিনের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি আবার ভদকা সেবন করতে থাকেন।

ভাবুন, স্তালিন এবং খ্রিস্টধর্মের প্রচার এবং কোক-সেবন! এই ব্যাঙ্গের মধ্যেই আছে স্তালিন সম্পর্কে দীর্ঘ দিনের পারসেপশনের জনমানসের কাহিনি।


প্রফুল্লচন্দ্র সেন

ঠিক এই কারণেই তো প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন হয়ে যান কাঁচকলা মন্ত্রী। তিনি ভোটযুদ্ধে পরাস্ত হন তাঁর সাধের আরামবাগ নির্বাচন কেন্দ্র থেকে। কী করলে মানুষের ভাল হবে তার চেয়েও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁদের ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় থাকা। বিবিসি প্রযোজিত ইয়েস প্রাইম মিনিস্টার শীর্ষক সিরিয়ালের এক দৃশ্যে অর্থসচিব ক্যাবিনেট সচিবকে বলছেন, বাজেটে সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা কমিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও জনপ্রিয় হতে চাইছেন। কিন্তু আপনি ক্যাবিনেট সচিব। মনে রাখবেন রাজনৈতিক নেতারা শিশুর মতো। তাঁরা যা চাইবেন তা-ই তাঁদের হাতে আমাদের দিয়ে দিতে হবে এমন কখনওই নয়। তাঁরা মানুষের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি জনপ্রিয় রাখতে মরিয়া। তাঁরা দেশের অর্থনীতি নিয়ে ভাবতেই চাইছেন না!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়


জ্যোতি বসু

আপনি কী কথা বলছেন জনসমক্ষে তার উপরও তৈরি হয় আপনার ভাবমূর্তি। তা সে তাপস পালই হোক আর রাষ্ট্রপতি-তনয় অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। যেমন ছিলেন সিপিএম নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত। এক বার তিনি বলে বসলেন, আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে রাজ্যপাল ধর্মবীরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চহ্বাণকে দমদম বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে সমাজবাদী বলে গ্রেফতার করতুম। এই মন্তব্যে অস্বস্তিতে পড়েন খোদ জ্যোতি বসু। এক বার নয়, বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটে। রাজ্যপাল ধর্মবীর যুক্তফ্রন্ট সরকারের তৈরি করা ভাষণ পুরো না পড়লে তাঁকে ঘেরাও করে রাখা হবে। বাস্তবে তা কিন্তু হয়নি। জ্যোতিবাবুকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলে বসেন, এমন কোনও কর্মসূচি তো দলের ছিল না।

জ্যোতিবাবু তিল তিল করে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন। এক বার বিড়লা রাইটার্সে আসতে রাজি না হলে তিনিই বিড়লার সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাসভবনে চলে যান। যে জ্যোতিবাবুকে ’৬৭-’৬৮ তে বিদেশি কূটনীতিক ও সাংবাদিকরা বলতেন, ভারতের লেনিন, তিনিই পরবর্তী কালে নয়া শিল্পনীতি ঘোষণা করে শিল্পপতিদের বন্ধু হয়ে ওঠেন। তাই পারসেপশন ধীরে ধীরে বদলায়। অনেকে সচেতন ভাবেও বদলান। রামমন্দিরের আডবাণী আর জিন্না মন্তব্যের বিতর্কের পরের আডবাণী এক মানুষ নন। গোধরা কলঙ্কিত মোদীরও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ধীরে ধীরে বদল হতে বাধ্য। গাঁধীজি অথবা নেলসন ম্যান্ডেলা সম্পর্কেও কত বই যে লেখা হয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। এই দু’টি চরিত্রের অনুষঙ্গ তাঁদের পোশাক ও কৃতকর্ম। গাঁধীর অর্ধনগ্ন পোশাক তাঁর সম্পর্কে পারসেপশন তৈরিতে যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি তিনি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে লন্ডনের শীতেও ওই পোশাকেই যান। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে থ্রি পিস কালো স্যুটে দেখলে আপনার প্রতিক্রিয়া সে রকমই হবে যদি মমতাকে দেখেন গাঢ় লাল রঙের সিল্কের শাড়িতে। অনেক সময় অবভাস ও বাস্তবতার সংঘাত বাঁধে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের সৃষ্ট মিথের হাতে বন্দি হয়ে যান।

আর্চি ব্রাউন তাঁর The Myth of The Strong Leader বইতে লিখেছেন, অনেক সময় স্ট্রং, মানে শক্তিশালী জবরদস্ত নেতা বা প্রশাসকের মিথ তৈরি করতে গিয়ে আমরা তাঁকে গণতন্ত্র বিরোধী একনায়ক বানিয়ে দিই। পারসেপশনের তত্ত্ব অনুযায়ী গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তনে আমরা কেউই দুর্বল নেতা চাই না। অতএব পারসেপশন এক বিষম গোলযোগ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন