ব্রিটেন বলিল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাহিরে চলিয়া যাইতে চাহে। ট্রাম্প খুব খুশি। তিনি তো গোটা প্রচারপর্ব জুড়িয়া বলিয়া আসিতেছেন, সমন্বয়ের তুলনায় বিচ্ছিন্নতা ভাল। উহাকে তিনি বলিতেছেন স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য। এইগুলি বলিলে লোকের মধ্যে একটি তপ্ত আবেগ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠে। আমিই আমার সকলটি নির্ধারণ করিব, কাহারও সাহায্য লইব না, ভাবিলে অপূর্ব স্বাভিমান জাগে। তাহা অহং-এর পক্ষে ভাল, এবং জীবন যাপনের পক্ষে বেশ খারাপ। বহু দেশে অভিবাসী বা শরণার্থীর জুজু দেখাইয়া দক্ষিণপন্থীরা প্রবল হুজুগ তুলিতেছে, সকল ‘বাহিরের মানুষ’ যত নষ্টের মূল, ইহাদের দূর করিয়া নিজেদের অঞ্চল নিজেরা গড়িবার প্রয়াসই বরণীয়। সাম্প্রতিক কালে সিরিয়া হইতে আগত মানুষের ঢল আছড়াইয়া পড়ায়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই স্বর চড়া হইয়াছে, প্রশ্রয়ও পাইতেছে, কারণ সাধারণ মানুষ ভিন্ন গোষ্ঠীর আগমনে বিরক্ত হয়, ইহাই তাহার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া অধিকাংশ সময়েই খুব নির্ভরযোগ্য নহে, কারণ তাহা চিন্তার পরিবর্তে প্রবৃত্তির উপর ভর করে বেশি। বহু বাঙালি উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া থাকেন, পশ্চিমবঙ্গ হইতে অ-বাঙালি কিছু গোষ্ঠী চলিয়া যাইলেই, বাংলা স্বর্ণখচিত হইয়া যাইবে। যদি তাঁহাদের কথা মানিয়া একটি দিনের জন্য বাংলাকে কেবলমাত্র বাঙালি-অধ্যুষিত করিয়া দেওয়া হয়, মুহূর্তে অর্থনীতি ভাঙিয়া পড়িবে, সমগ্র পরিকাঠামো ধসিয়া যাইবে, কারণ ব্যবসায়, শ্রম— এই ক্ষেত্রগুলিকে যাহারা ধরিয়া রাখিয়াছে, তাহারাই থাকিবে না। ইউরোপে যদি অভিবাসীগণকে সহসা বিয়োগ করিয়া দেওয়া হয়, অর্থভাণ্ডার তো শুকাইয়া যাইবেই, মনুষ্যসম্পদে এই মহাদেশ প্রবল দরিদ্র হইয়া পড়িবে।
এমন হইতেই পারে, একটি দেশ ঠিক করিল, কাহাকে সে আসিতে দিবে ও কাহাকে দিবে না, সেই নিয়ন্ত্রণ কেবল তাহার হাতে থাকিবে, কোনও বৃহৎ সংঘের কর্তালি দ্বারা তাহা নিয়ন্ত্রিত হইবে না। তাহার আপত্তি অভিবাসনে নহে, অন্যের সিদ্ধান্ত মানিতে বাধ্য হওয়ায়। মুশকিল হইল, যাঁহারা এই আত্মনির্ভরতার কথা বলিতেছেন, অধিকাংশের বক্তব্যে নিহিত থাকিতেছে মানুষের মজ্জাগত সাম্প্রদায়িকতার প্রতি উসকানি। অন্য রকম যে লোক, তাহার প্রতি ঔৎসুক্য বোধ করিবার বদলে, তাহার নিকট নূতনের সন্ধানে সানন্দে যাইবার বদলে, অস্বস্তি ভরে তাহাকে বর্জন করিবার প্রতিই মানুষের ঝোঁক। এই প্রবণতাকে যুক্তি ও বোধ দ্বারা, নিজের ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করিয়া বৃহতের প্রতি সুযাত্রা দ্বারা ধৌত করিয়া লওয়াই মানবতার প্রকৃত প্রক্রিয়া। আশ্চর্য হইল, সোশ্যাল মিডিয়া আসিয়া যতই পৃথিবীকে উন্মুক্ত করিতেছে, ততই যেন এই গ্রহ শীর্ণ, বদ্ধ হইয়া উঠিতেছে। কেবল ব্রিটেন নহে, দেশে দেশে— বাকি বিশ্বকে সরাইয়া, এড়াইয়া, নিজেদের কূপ নির্মাণ করিয়া তাহাতে থাকিব, প্রসারকে অস্বীকার করিয়া সঙ্কোচনকে মাথায় তুলিয়া নাচিব, স্বার্থপরতাকে স্ববশতা বলিয়া ভাবিব, এই বিদ্বেষকেন্দ্রিক আবেগ জিতিতেছে। ইহাতে ইন্ধন জোগাইতেছে আর এক আবেগ: নস্টালজিয়া। সকলেরই ধারণা, তাহাদের দেশ পূর্বে এক আশ্চর্য রূপকথার মুলুক ছিল। স্মৃতির সুবিধা হইল, তাহা অস্বস্তিকর অংশগুলি প্রায়শ ছাঁটিয়া দেয়। হয়তো স্বর্ণ তখন সুলভ ছিল, আবার ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুও ছিল অধিক। হয়তো অরণ্য ছিল অধিক, তাই দূষণ কম ছিল, কিন্তু নাগরিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যও ছিল কম, প্রযুক্তিও কম। কিন্তু তলাইয়া না ভাবিয়া, সেই হারাইয়া যাওয়া স্বর্ণযুগটি ফিরাইতে, মানুুষ সেই মানুষদের বাহির করিয়া দিতে চাহে, তখনও যাহারা আসে নাই। ভুলিয়া যায়, অসংস্রব নহে, সহায়তাই সভ্যতার ভিত্তি। এই অনাধুনিক চিন্তাগুলিকে দূর করা যাঁহাদের কর্তব্য, তাঁহারা প্রায়ই ক্ষমতালোভে উলটোবাগে জনগণকে চালিত করেন। ইঁহাদের ‘এক্সিট’ ঘটিবে কোন গণভোটে?
যৎকিঞ্চিৎ
নন্দনে একটি বাংলা ছবিকে আটকে দেওয়া হল। সেটা সেন্সর ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু নন্দনকর্তাদের অস্বস্তি জেগেছে। উড়তা পঞ্জাব-এর বেলায় বাংলা থেকে বাক্স্বাধীনতার সমর্থনে সিংহনাদ উঠেছিল, এ বার তার সিকি ভাগও নেই। আসলে এই ছবিতে অনুুরাগ কাশ্যপের মতো হেভিওয়েট জড়িয়ে নেই, তার চেয়ে বড়: ঘটনাটা বড্ড কাছাকাছি ঘটছে। রাজ্যের কাউকে চটিয়ে দিলে, নিজের পরবর্তী বাংলা ছবিটি যদি হোঁচট খায়? তার চেয়ে, আনমনে হালুয়া খাচ্ছিলাম, খবর দেখিনি: শ্রেয় পন্থা!