প্রবন্ধ ১

গুজরাত মডেল: একটু জেনে নিলে ভাল হয়

অনেক দিন ধরে গুজরাত মডেল নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, সেটা ভাল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল, বেশির ভাগ কথাই হচ্ছে গুজরাত সম্পর্কে কিচ্ছু না জেনে। বিশেষ করে যা আমাকে অবাক করে দেয় তা হল, ‘গুজরাত মডেল’ বললেই কতকগুলো পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। আয়বৃদ্ধি, বিনিয়োগ, বিভিন্ন সামাজিক মাপকাঠিতে রাজ্যের অগ্রগতি, এই সব বিষয়ে পরিসংখ্যান। এগুলো দরকারি, এগুলো নিয়ে আলোচনা নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু এগুলো তো মডেল হতে পারে না!

Advertisement

বিবেক দেবরায়

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৪ ০০:০৫
Share:

আনন্দনিকেতন। আমদাবাদের একটি স্কুল। ছবি সৌজন্য: ‘ড্রামবিটস টু রিংটোনস’, গুজরাত’স স্ট্র্যাটেজি ফর এমপাওয়ারিং ট্রাইবালস। বিবেক দেবরায় ও রাধিকা শাহ। আখ্যা মিডিয়া সার্ভিস, ২০১৪

অনেক দিন ধরে গুজরাত মডেল নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, সেটা ভাল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল, বেশির ভাগ কথাই হচ্ছে গুজরাত সম্পর্কে কিচ্ছু না জেনে। বিশেষ করে যা আমাকে অবাক করে দেয় তা হল, ‘গুজরাত মডেল’ বললেই কতকগুলো পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। আয়বৃদ্ধি, বিনিয়োগ, বিভিন্ন সামাজিক মাপকাঠিতে রাজ্যের অগ্রগতি, এই সব বিষয়ে পরিসংখ্যান। এগুলো দরকারি, এগুলো নিয়ে আলোচনা নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু এগুলো তো মডেল হতে পারে না! গুজরাত মডেলটা তবে কী? আমি তার কয়েকটা দিক নিয়ে সংক্ষেপে বলব। প্রথমেই বলে রাখি, গুজরাত মডেল বলতে কোনও আনকোরা কার্যক্রম নয়, কোনও ম্যাজিকও নয়। কী ভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের কাজগুলো ঠিক ভাবে করা যায়, তার চেষ্টা করা হয়েছে এই রাজ্যে। এখনও অনেক কিছুই করা হয়নি, আরও অনেক কিছু করা দরকার, যা করা হয়েছে সেটাও অনেক সময়েই আরও ভাল ভাবে করা দরকার। কিন্তু নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে কী ভাবে নানা ক্ষেত্রে এগোনো যায়, গুজরাতের অভিজ্ঞতা থেকে তার কিছু দৃষ্টান্ত দেব।

Advertisement

গুজরাতে কয়েকটা জিনিসের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, বেসরকারি উদ্যোগকে কাজে লাগানোর জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করা হয়েছে, বিশেষ করে দক্ষতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়ত, সব কিছু সরকারি আদেশ দিয়ে ঠিক না করে বাজারের সাহায্য নেওয়া হয়েছে, বাজারদরকে ব্যবহার করা হয়েছে সংকেত হিসেবে। তিন, দরিদ্রদের সব কিছু বিনা পয়সায় না দিয়ে একটা প্রতীকী দাম বা মাসুল নেওয়া হয়, সেটাও এই বাজারনির্ভর নীতির অঙ্গ। চার, বিকেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা, প্রশাসন চালানোর কাজে প্রযুক্তির কুশলী ব্যবহার— এগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। এগুলো নিয়েই গুজরাত মডেল। এখানে কোনও অর্থনৈতিক তত্ত্ব খুঁজতে গেলে ভুল হবে। কী ভাবে একটা কার্যকর প্রশাসন এবং তার ভিত্তিতে একটা কার্যকর উন্নয়ন সম্ভবপর হতে পারে, গুজরাত সেটাই করে দেখাচ্ছে। অন্য নানা রাজ্যে এই পথে কিছু কিছু চেষ্টা হয়েছে বটে, কিন্তু সামগ্রিক এবং সুসংহত উদ্যোগ হিসেবে গুজরাত অবশ্যই স্বতন্ত্র। কয়েকটা নির্দিষ্ট উদাহরণ দিচ্ছি।

প্রথমেই বলি স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা। আমাদের দেশে এই ধারণা খুব প্রচলিত যে, স্বাস্থ্য পরিষেবা সরকারের দায়িত্ব। সরকারি চিকিৎসার হাল বহু জায়গায় খুব খারাপ, তা সত্ত্বেও অনেকেরই বক্তব্য, কেরলে যখন স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রধানত সরকারই দেয়, তখন অন্য সব রাজ্যেও তা-ই দিতে হবে। অথচ সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরি করাটা উদ্দেশ্য হতে পারে না, আসল কথা হল চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত, সেটা যে ভাবেই হোক। এই সত্যটা বেশ কিছু রাজ্যই বুঝেছে, সেই অনুযায়ী কাজও করেছে। যেমন, অনেক রাজ্যেই এখন বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা চালু হয়েছে, যার ফলে প্রসূতি মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে, কমেছে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হারও। গুজরাতে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায় (পিপিপি) একটা বিশেষ ব্যবস্থা চালু হয়েছে: চিরঞ্জীবী যোজনা। গরিব ঘরের প্রসূতিরা সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা তালিকাভুক্ত বেসরকারি চিকিৎসালয়, যেখানেই ভর্তি হোন, সন্তান জন্মের খরচ সরকার মেটায়।

Advertisement

এ বার শিক্ষার কথা। সরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ ছিল। ইন্টারভিউয়ের সময় ঘুষ চাওয়া হত। শুধুমাত্র পরীক্ষার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করলে এই সমস্যা এড়ানো যায়, কিন্তু তাতে আবার শিক্ষকের যোগ্যতা পুরোপুরি যাচাই করা যায় না। এই সমস্যার সমাধানে গুজরাতে এখন সরকারি শিক্ষকদের প্রথমে পাঁচ বছরের চুক্তিতে কাজ দেওয়া হয়। ঠিক মতো পড়াতে পারলে তবেই চাকরি পাকা হবে। ‘গুণোৎসব’ নামে একটি বিশেষ প্রকল্পে মন্ত্রী এবং আধিকারিকরা আঠারো হাজার গ্রামের স্কুলে স্কুলে হাজির হয়ে লেখাপড়ার মান যাচাই করেন, তার ফলে স্কুলগুলির মান উন্নয়নের একটা চাপ তৈরি হয়। মেয়েদের স্কুলে ভর্তির হার বাড়ানোর জন্যও আছে বিশেষ প্রকল্প।

সরকারি নীতি বলতে সচরাচর ওপরতলা থেকে হুকুম জারি করা বোঝায়। কিন্তু অনেক সময়েই হুকুম না দিয়ে উৎসাহ দিলে অভীষ্ট পূরণের সম্ভাবনা বাড়ে। এবং উৎসাহটা নানা ক্ষেত্রে আর্থিক উৎসাহও হতে পারে। দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথমত, পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে অশান্তি অনেক রাজ্যেই পরিচিত ব্যাপার। গুজরাতে এই অশান্তি কমানোর জন্য একটা নিয়ম চালু হয়েছে। যেখানে ঐকমত্যের ভিত্তিতে পঞ্চায়েত সদস্য নির্বাচিত হবেন, সেখানে সরকার থেকে বিশেষ আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে। একই ভাবে, মহিলা সদস্য পিছু পঞ্চায়েতকে বিশেষ সরকারি সাহায্য দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, পাবন গ্রাম বা তীর্থ গ্রাম নামক পরিকল্পনা চালু হয়েছে। যে গ্রামে তিন বছরে কোনও অশান্তির ঘটনায় এফ আই আর দাখিল করা হয়নি, সেখানেও সরকার বিশেষ সাহায্য দেয়। লক্ষ করার বিষয় হল, প্রথম দৃষ্টান্তে আর্থিক উৎসাহ ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক কাঠামোটিকে সুষ্ঠু ভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আর্থিক উৎসাহ কাজে লাগানো হয়েছে প্রশাসনের উন্নতি ঘটানোর জন্য।

প্রশাসনিক উন্নতির জন্য প্রযুক্তির ব্যবহারও চমকপ্রদ। যেমন, দুর্নীতি কমানোর জন্য তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার করা হয়েছে এই রাজ্যে। একটা দৃষ্টান্ত দিই। প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সঙ্গে সীমান্তে যে সব টোল বুথ আছে, গুজরাত সরকার সেগুলিকে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় করেছে। এর ফলে একই পণ্য চলাচলের ওপর অথচ প্রতিবেশী মহারাষ্ট্র বা রাজস্থানের তুলনায় গুজরাতে রাজস্ব অনেক বেড়েছে। সরকারি ক্ষেত্রে নানান জিনিসপত্র কেনা বা ইনস্পেকশনের কাজেও আইটি’র সুষ্ঠু প্রয়োগে দুর্নীতি কমেছে, রাজস্ব বেড়েছে।

অন্য ভাবেও আই টি’র সাহায্যে প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ লক্ষণীয়। যেমন, রাজ্যের আঠারো হাজার গ্রামের প্রায় সবগুলিই গুজরাত স্টেট ওয়াইড এরিয়া নেটওয়ার্ক (জিএসওয়্যান) মারফত পরস্পর সংযুক্ত হয়েছে, শ’দুয়েক মাত্র এখনও এর বাইরে। এর ফলে কেবল ই-প্রশাসনের সুবিধে হয়নি, নাগরিকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাও অনেক উন্নত হয়েছে। এ জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থাও চালু হয়েছে রাজ্যে, তার নাম: স্বাগত।

আর্থিক উন্নয়নেও প্রযুক্তির নানা উদ্ভাবনী ব্যবহার করা হয়েছে। ভাস্করাচার্য ইনস্টিটিউট ফর স্পেস অ্যাপ্লিকেশনস অ্যান্ড জিয়ো ইনফর্মেটিক্স (বিস্যাগ) সম্পর্কে রাজ্যের বাইরে বিশেষ কেউ জানে না। কৃষি, জমি, জলসম্পদ, জলাভূমি, অরণ্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির (জি আই এস) সাহায্যে বিশদ তথ্য পরিসংখ্যান ব্যবহার করে উন্নয়নের বিরাট প্রসার ঘটানো হয়েছে। বিস্যাগ কিন্তু কোনও সরকারি ভর্তুকি পায় না।

বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে অনেক রাজ্যেই অনেক বড় বড় কথা বলা হয়। গুজরাতের কয়েকটি কার্যকর প্রকল্পের কথা বলি। দরিদ্র নাগরিকদের বিভিন্ন পরিষেবা পাওয়ার জন্য যাতে সরকারের কাছে যেতে না হয়, সরকারই যাতে তাঁদের কাছে আসে, সে জন্য গরিব কল্যাণ মেলা, কৃষি মহোৎসব বা এমনকী সয়েল হেলথ কার্ড-এর মতো নানা বন্দোবস্ত আছে এবং সেগুলি সুষ্ঠু ভাবে কাজ করে। বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ হিসেবে বলা যায় ‘অপনো তালুক ভাইব্র্যান্ট তালুক’-এর কথাও। উপজেলা বা তালুক স্তরের উন্নয়ন পরিকল্পনা সেই স্তরেই করা হয়। বিশেষ করে, একচল্লিশটি অনগ্রসর তালুকের উন্নয়নের জন্য একচল্লিশ জন উচ্চপদস্থ আধিকারিককে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল বাজারের ব্যবহার। দরিদ্রদেরও এ রাজ্যে বিনা পয়সায় সমস্ত পরিষেবা দেওয়া হয় না, একটা ন্যূনতম মাত্রার ওপরে সব কিছুর জন্যই অল্প কিছু হলেও টাকা নেওয়া হয়। যেমন, জনজাতিভুক্ত কোনও পরিবার হয়তো দুটি মোষ বিনা পয়সায় পাবেন, কিন্তু তার চেয়ে বেশি পেতে হলে কিছু টাকা দিতে হবে। জল এবং বিদ্যুতের জন্যেও কিছু মাসুল দিতে হয়। এর ফলে পরিষেবার গুণমান ধরে রাখতে সুবিধে হয়, কারণ বিনা পয়সায় পরিষেবা মেলে না বলে মানুষ তার উৎকর্ষ দাবি করেন, সরবরাহে ত্রুটি দেখা দিলে তাঁরা চাপ সৃষ্টি করেন, ‘নিখরচায় যা পাই তা-ই সই’ ভেবে মেনে নেন না।

মোদ্দা কথাটা পরিষ্কার। গুজরাতে উন্নয়নের কাজগুলো যে ভাবে করা হয়েছে, তার মধ্যে অনেক কিছু ভাবার আছে, শেখারও। কোন রাজ্যে এই নীতি ও পদ্ধতিগুলো কতটা কাজে লাগানো যায় বা কাজে লাগানোর দরকার আছে, সেটা অবশ্যই বিচার করে দেখতে হবে। কিন্তু কিছু না জেনে নানান আলটপকা মন্তব্য করার আগে এক বার একটু জেনে নেওয়া ভাল নয় কি?

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন