রবীন্দ্রনাথ মোহ আবরণ খুলিয়া দেওয়ার প্রার্থনা করিয়াছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাহা পূর্ণ করিলেন। নির্বাচনী গোলযোগ পশ্চিমবঙ্গে নূতন নহে। কিন্তু বিধাননগরের মতো ‘নাগরিক’ এলাকার পুরভোটে শনিবার যাহা ঘটিয়াছে তাহার নগ্নতা, এই তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গেও, স্তম্ভিত করিয়া দেয়। অনুমান করা যায়, গণতন্ত্র এবং প্রশাসনের সমস্ত বহিরাবরণ খুলিয়া ফেলিয়া তাহাদের বক্ষে স্বৈরতন্ত্রের পদচিহ্ন আঁকিয়া দেওয়ার এই নিরঙ্কুশ গুন্ডামি ক্রমে সম্প্রসারিত হইবে, বিধাননগরে সূর্যোদয়ের যে আলোকরেখা পড়িয়াছে, অচিরেই তাহার ঝরনাধারায় সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ ধৌত হইবে। ‘ভোট করিবার’ এক সুবিস্তৃত এবং সুপরিকল্পিত ‘মেশিনারি’ তৈয়ারি করিয়া বামফ্রন্ট বিখ্যাত হইয়াছিল, কুখ্যাতও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সোনার বাংলায় কোনও পরিকল্পিত ভোটযন্ত্রের প্রয়োজন নাই, গুন্ডাবাহিনী প্রস্তুত, বাইকে তেল ভরা আছে, যখন যেখানে দরকার মুখে ফেটি বাঁধিয়া অথবা না বাঁধিয়াই ঝাঁপাইয়া পড়িবে, তাহাদের বাধা দিলে, এমনকী প্রশ্ন করিলেও নগদ বিদায় হিসাবে মিলিবে বেধড়ক মার। ‘এই দুর্বৃত্তদের উপর নেতৃত্বের কোনও নিয়ন্ত্রণ নাই’ বলিলে পনেরো আনা সত্যই অনুক্ত থাকিয়া যায়। এই দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণের কোনও বাসনাই নেতৃত্বের নাই। তাহারা স্বরাট।
দুষ্টের দমন যাহাদের বিধিবদ্ধ কাজ, সেই কাজের জন্য যাহারা জনসাধারণের অর্থে বেতন পাইয়া থাকে, সেই পুলিশও আপন ভূমিকায় একনিষ্ঠ। চোখের সামনে আইনের শাসন, প্রতিবাদী নাগরিক এবং কর্তব্যরত সাংবাদিককে ভূলুণ্ঠিত এবং নির্যাতিত হইতে দেখিলেও তাহারা নিষ্কম্প; চোখ বুজিবারও প্রয়োজন হয় না, খোলা চোখে কর্তারা নির্দেশ দিতে পারেন: তাড়া করিবার প্রয়োজন নাই, উহারা আপনিই চলিয়া যাইবে। সত্যই তো, কার্যসিদ্ধির পরে গুন্ডারা তো চলিয়া যাইবেই, সময় নষ্ট করিবার মতো সময় তাহাদের থাকিবে কেন? কর্তব্য পালনের তাগিদ পুলিশের নাই, কারণ সর্বাধিনায়িকা এবং তাঁহার মনসবদারেরা বিরোধীদের উপর দায় চাপাইয়া দিয়াছেন এবং নির্বাচন কমিশনার ‘কোনও মন্তব্য নয়’ ঘোষণা করিয়া জানাইয়া দিয়াছেন, তাঁহার তরোয়াল নাই, ঢাল আছে। পুলিশ-কর্তাদের আত্মমর্যাদা? সেই বস্তুটি এই রাজ্যে দশকের পর দশক ধরিয়া নষ্ট করা হইয়াছে, মেরুদণ্ড ক্রমে নরম হইয়াছে, হাতে রহিয়াছে জো হুজুর।
তবু পথ নিষ্কণ্টক হয় না। হুজুরের রাজপথে কাঁটা বিছাইয়া চলে সংবাদমাধ্যম। শব্দে ও ছবিতে সাংবাদিকরা সত্যকে উন্মোচন করেন এবং জনসমক্ষে পেশ করিতে থাকেন। ‘মিথ্যা’ বা ‘বিকৃত’ বলিয়া পার পাওয়া যায় না, কারণ দর্শকরা দৃশ্যগুলি স্বচক্ষে দেখিতেছেন, কথাগুলি স্বকর্ণে শুনিতেছেন, লেখাগুলি স্বজ্ঞানে পড়িতেছেন। যাহারা গণতন্ত্রকে লুঠ করিতে চাহে, তাহারা স্বভাবতই এই সত্যকে ভয় পায়। ক্ষমতার শীর্ষস্তর হইতে শুরু করিয়া তৃণ-মূলের গুন্ডাবাহিনী, সকলেই সেই ভয়ের শিকার। এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা নানা ভাবে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করিতে তৎপর হন, এই কারণেই ভোটের তাণ্ডবচিত্র প্রচারের অপরাধে সাংবাদিকরা পৈশাচিক নির্মমতায় প্রহৃত হন। ফ্যাসিবাদ শব্দটি বহুব্যবহারে জীর্ণ, কিন্তু শনিবার সাংবাদিকদের উপর যে আক্রমণ নামিয়া আসিয়াছে, তাহার পরে পশ্চিমবঙ্গে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের মূর্তিটিকে অস্বীকার করিবার আর কোনও উপায় নাই। একটি পুরসভার জন্য কেন সেই মূর্তিটিকে এতখানি নিরাবরণ করিয়া দেওয়া হইল? গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব? শিলিগুড়ি মডেল-এর ভয়? একচ্ছত্র আধিপত্যের স্বাভাবিক তাড়না? বিরোধীদের সমঝাইয়া দেওয়ার অত্যুৎসাহ? বঙ্গেশ্বরী জানেন। অথবা তিনিও জানেন না। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কি তাঁহার সৃষ্টির পরিণাম জানিতেন?