প্রবন্ধ ১

গণতন্ত্রই এখন স্বৈরাচারীর তন্ত্র চায়

ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদীর মতো ‘ফিনিশিং লাইনে’ পৌঁছতে পারবেন কি না, জানা নেই। তবে সেটাই বড় কথা নয়। এ বারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যুদ্ধের আসল বিষয় হল, তাঁর উত্থানের এই সাধারণবুদ্ধি-অতিক্রমী ইতিহাস।ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদীর মতো ‘ফিনিশিং লাইনে’ পৌঁছতে পারবেন কি না, জানা নেই। তবে সেটাই বড় কথা নয়। এ বারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যুদ্ধের আসল বিষয় হল, তাঁর উত্থানের এই সাধারণবুদ্ধি-অতিক্রমী ইতিহাস।

Advertisement

ভাস্কর চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৬ ০০:২৬
Share:

এ বার অনুদার-পন্থা। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদ-প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। এএফপি

ঠি ক তুল্যমূল্য বলা যাবে না। এক জন চা-ওয়ালার েছলে। অন্য জন কোটিপতি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর উত্তরাধিকারী। ছেলেবেলাতেই এক জনের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। অন্য জন রাজনীতির আঙিনায় উদ্ভ্রান্ত অবিবেচনার কারবারি। রংবেরঙের শিরোভূষণ পরে এক জন জ্বলন্ত বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। অন্য জন যেখানেই যান, যাঁদের উদ্দেশ্যেই প্রচার করুন, তাঁর মাথাটি যেন সব সময়েই পাখির ভাঙাচোরা বাসা! এত পার্থক্য, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন সমাজের অপ্রত্যাশিত সমর্থন-প্লাবনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে একটা আকুলতা। সাধারণ মানুষ, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে, চাইছেন এক জন বলিষ্ঠ নেতাকে। এমন এক জন নেতাকে যিনি হবেন প্রবল ক্ষমতাশালী়। অন্তহীন নীতি-প্রণয়নের জালে যিনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলবেন না, ঐকমত্য তৈরির ‘ব্যর্থ’ চেষ্টায় সময় নষ্ট করবেন না। ২০১৪ সালে ভারতে সাধারণ নির্বাচনের সময় এমন একটা ‘আকুলতা’ টের পাওয়া গিয়েছিল, নরেন্দ্র মোদী নামে এক ‘বহিরাগত’কে দিল্লির ভার দেওয়ার জন্য দেশ জুড়ে জনমত প্রবল হয়ে উঠেছিল। ওই বছরই হাঙ্গারিতে দেখা গিয়েছিল প্রবলপুরুষ ভিক্টর অরবানকে ল্যান্ডস্লাইড ভোটে জেতানোর জন্য একই ধরনের আকুলতা। ২০১৫ সালে পোল্যান্ডেও দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের সমর্থনে ছিল একই জনমতের প্লাবন। এই ইয়ারোস্ল কাতজিনস্কি-র রাজনীতি সম্পর্কে লিবারেল সংবাদমাধ্যমে বলা হল, যাঁরা ‘সংবাদমাধ্যমের সমালোচক, বা নিরামিষাশী, কিংবা সাইকেল-প্রেমীদের সহ্য করতে পারেন না’, তাঁরাই পোল্যান্ডে সরকার গড়লেন! ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। লিবারেল গণতন্ত্রের জন্য এই তিন ধরনের মানুষই বিশেষ উদ্গ্রীব থাকেন কিনা! দুনিয়া জুড়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য এই বেপরোয়া আকুলতা এখন অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। তুরস্কের এর্দোগান, নাইজিরিয়ার বুহারি, মিশরের সিসি, রাশিয়ার পুতিন কিংবা চিনের শি চিনফিংয়ের কথা মনে করা যেতে পারে।

Advertisement

কোথা থেকে এল এই আকুলতা? তলিয়ে ভাবতে গেলে মনে হয়, ২০০৮-এর মন্দার অস্থিরতার সঙ্গে যখন যোগ হল নতুন সব ভূরাজনৈতিক সংকট, ধর্মীয় সংঘাত, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা, এবং তার সঙ্গে প্রযুক্তি দুনিয়ার বিপ্লব, সেখান থেকেই বিষয়টা বুঝতে শুরু করতে হবে। সব মিলিয়ে সেই সময় অকস্মাৎ বাজার থেকে চাকরি উধাও হল। তৈরি হল অদ্ভুত অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা। বিশ্বের প্রায় সর্বত্র তার সুগভীর ছাপ পড়ল। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি স্বভাবতই হল এই অস্থিরতার সবচেয়ে বড় শিকার। তাদের বদ্ধমূল সন্দেহ দাঁড়াল, এলিটদের চক্রান্তেই তাদের এমন দুরবস্থা। আর বুদ্ধিজীবী মহল থেকে শুরু হল জটিল বাস্তবের জটিলতর সব বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া গেল অত্যন্ত অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি: ‘অচ্ছে দি আনেওয়ালে হৈ’ কিংবা ‘মেক আমেরিকা গ্রেট আগেন’। এই সব মনোহারী স্লোগান মোটের উপর একই কথা বলতে চায়, চটজলদি আশার বুদবুদ তৈরি করতে চায়, যাতে মানুষের মনে হয়, এই তো, সব ভাল জিনিস হাতের মুঠোয় এল বলে! এই অাকাশকুসুম থেকেই বেরিয়ে আসে এক অবধারিত রাজনীতির ফরমুলা। প্রথম কাজ, যারা ক্ষমতায় আছে তাদের ছুড়ে ফেলো। তার পর, এমন এক জন নেতাকে নিয়ে এসো যিনি সমস্ত সংঘাত-দ্বন্দ্ব ইত্যাদি পেরিয়ে, অর্থনীতির ভুয়ো বকবকানির জালটি ফাঁসিয়ে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে কূটনীতির কর্দম জমি পেরিয়ে আমাদের যুগান্তরে নিয়ে যাবেন। প্রশাসনেও যুগান্তর ঘটবে। সেই নেতা বলবেন ‘জাস্ট ডু ইট’। কেবল বলবেন না, নিজে ঠিক সেটা-ই করে দেখাবেন!

এ সব দেখেশুনে বুদ্ধিজীবীরা ভয়ে আধমরা হওয়ার জোগাড়। বিশ শতকের ইতিহাস দেখে কি মানুষ কিছুই শিখল না? সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে এটুকু বুঝল না যে, সর্বশক্তিমান স্বৈরাচারীর থেকে উদার গণতন্ত্র অনেক বেশি কাম্য? প্রযুক্তি বিপ্লব, টেলিকমিউনিকেশন, পরিবহণ বিপ্লব, ইন্টারনেট, এ সবের মধ্যে দিয়েও তো মানবসভ্যতার বিকেন্দ্রীকরণের বার্তাই বেরিয়ে এসেছিল— বোঝা গেল না যে বিকেন্দ্রিত সমাজেই মঙ্গলের সম্ভাবনা! এমআইটি-হার্ভার্ড থেকে বেরোনো ড্যারন আচেমোগলু আর জেমস রবিনসন-এর সাড়া-জাগানো বই হোয়াই নেশনস ফেল কি পড়েনি এরা, যাতে বলা হয়েছিল ‘ইনক্লুসিভ’ বা সর্বমতসমন্বিত রাজনৈতিক নেতৃত্বই বাঁচার শ্রেষ্ঠ রাস্তা, স্বৈরতন্ত্র মাত্রেই নেশন-এর সর্বনাশ? এত কিছুর পর একুশ শতকে এসে ফের সাধ করে স্বৈরাচারীদের ডেকে আনা?

Advertisement

এশিয়া, তথাকথিত মধ্য প্রাচ্য, ইউরোপ: এই সব জায়গার বুদ্ধিজীবীদের দেখে দেখে মনে হয়, এঁরা মার্কিন দেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান দেখে বিস্ময়ের গোলকধাঁধায় হাবুডুবু খাচ্ছেন। এঁদের একটাই ছোট কথা বলার আছে। ‘ট্রাম্পিজ্ম’ আমেরিকার একার বাস্তব নয়। সব দেশই এই রাস্তায় ইতিমধ্যে হেঁটে ফেলেছে। আমেরিকা কেবল দৌড়ে তাদের পিছন থেকে ধরার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা অন্য ভাবেও বোঝা যেতে পারে। এক এক করে দেখা যেতে পারে, এই ‘নিউ অ্যাবনরমাল’ বা নতুন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কেন তৈরি হল, কোন বিষয়গুলোকে এর ‘সাধারণ চারিত্রলক্ষণ’ বলে ধরা যেতে পারে।

প্রথমত, যখন ‘নিউ নরমাল’ বা ‘নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতি’ আমাদের স্বার্থের পক্ষে বিশেষ সুবিধেজনক হয় না, ‘নিউ অ্যাবনরমাল’-এর হাতছানিটি তখন প্রবল হয়ে ওঠে, সে যতই অস্বাভাবিক হোক না কেন। বিশ শতকের শেষ দিকে হাওয়ায় ভেসে আসা প্রতিশ্রুতিগুলি এক বার চট করে মনে করা যাক। ইন্টারনেট! বিশ্বায়ন! নতুন বাজার! দারিদ্রের অবসান! এই শতকের প্রথম ক’টি বছরে কিন্তু মনে হল— না, ব্যাপারগুলো বোধহয় অত সহজ নয়। উন্নতির যে রেখাগুলোকে আগে সরলরেখা মনে হয়েছিল, আস্তে আস্তে সেগুলো ইউ-টার্ন-এর মতো ঠেকতে লাগল! প্রত্যাশার পাহাড় থেকে পপাত চ মমার চ হতে বেশি সময় লাগল না।

কিংবা, হয়তো মনে হতে শুরু করল, সত্যিকারের পরিবর্তন আনা এমন কারও পক্ষে সম্ভব, যিনি বা যাঁরা উপস্থিত ক্ষমতাবিন্যাস থেকে লাভবান হওয়ার আশা রাখেন না। অর্থাৎ কোনও ‘বহিরাগত’। এই ডিজিটাল যুগে, প্রচারমাধ্যমের অবিরাম উদ্ভাস-ধৌত বিশ্বে ‘বহিরাগত’দের পক্ষে যে সহজেই নজর কেড়ে নেওয়া সম্ভব, সে আমরা জানি। এমন বার্তা দেওয়া সম্ভব যা নিমেষে আগাপাশতলা পাল্টে দেওয়ার রাস্তা দেখাবে! ১৪০ অক্ষরে সেই বার্তা মুহূর্তে দূরদূরান্তরে ছড়িয়ে দেবে। আগেকার দিন হলে এ কাজ বেশ কঠিন হত, প্রচলিত সামাজিক প্রেশার-ভাল্ভগুলিই সেটা আটকে দিত।

‘সর্বমতের ঐক্য’ ইত্যাদি কথা তাই এখন কেবল দুর্নীতিবাজির ভূমিকা হিসেবে গৃহীত হয়। বরং অনেকে যদি একটি বিষয়ে একমত হয়ে যান, ধরে নেওয়া হয়, তার মানে হল, অনেকের অনেক স্বার্থপূরণের সম্ভাবনা, এককাট্টা হয়ে আখের গোছানোর সম্ভাবনা। উল্টো দিকে, কোনও নেতা যদি বেশ ‘একলা চলো’ এবং ‘এক-শাসনের পথে একলা চলো’ টাইপের হন, তা হলে মানুষ এখন বুঝে নেয়, তাঁর কাউকে কিছু দেওয়ার নেই, কারও কাছ থেকে কিছু পাওয়ারও নেই। অর্থাৎ, তাঁর ভাবমূর্তি ‘পরিচ্ছন্ন’! অর্থাৎ তিনি সোজাসুজি ‘মানুষের’ জন্য কাজ করছেন, কোনও স্বার্থগোষ্ঠীর হয়ে কাজ করছেন না।

বিশ্বের অন্যান্য উদীয়মান স্বনির্মিত নেতার মতোই ট্রাম্পও কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিতর থেকেই উঠে আসছেন, কেননা গণতন্ত্রই মানুষকে তাদের ইচ্ছেমতো যে কোনও নেতা নির্বাচনের অধিকার দিয়েছে। সেই নেতা যদি অগণতান্ত্রিক হন, তবুও তাঁকে বেছে নেওয়ার অধিকার মানুষের আছে। এই সর্বজনীন অধিকারই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। এবং সবচেয়ে বড় বিপদ! মোদীর মতো ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত ‘ফিনিশিং লাইনে’ পৌঁছতে পারবেন কি না, জানা নেই। তবে আমার মতে, সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা, তাঁর উত্থানের সাধারণবুদ্ধি-অতিক্রমী এই ইতিহাস। সাধারণ মার্কিন ভোটারের মন সম্বন্ধে এই ঘটনা যা বলছে। একটা ব্যাপার স্পষ্ট। মার্কিন ভোটার এ ক্ষেত্রে ভারতীয় বা পোলিশ বা নাইজিরিয়ান ভোটারের থেকে একটুও আলাদা নন!

অর্থাৎ, বিশ শতকের সব সত্যই উল্টেপাল্টে যায়নি। বিশ্বায়ন থেকে গিয়েছে, হয়তো থেকে যােব। নেতৃচালিত হওয়ার বিশ্বায়িত প্রবণতাটাও থেকে গিয়েছে। তার মানে যদি নেতার হাত ধরে নীচের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়া হয়, তবুও।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টাফট্‌স ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার ইনস্টিটিউট ফর বিজনেস-এর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যান্ড ফিনান্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট ডিন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন