মাতৃত্বের ছুটি বাড়িতেছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করিয়াছে, সরকারি ও বেসরকারি সকল ক্ষেত্রেই ২৬ সপ্তাহ ছুটি মিলিবার ব্যবস্থা হইবে। বেসরকারি ক্ষেত্রে মহিলাদের সাধারণত ১২ সপ্তাহ ছুটি মিলে। নূতন নিয়মে প্রাপ্য ছুটি তাহার দ্বিগুণেরও অধিক হইবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের মতে ১৮ সপ্তাহ মাতৃত্বের ছুটি প্রয়োজন। কিন্তু মাত্র ৪০টি দেশ তাহা দিয়া থাকে। ভারত এই উন্নততর দেশগুলির মধ্যে স্থান পাইবে, ইহা সুসংবাদ। সদ্যোজাত সন্তানকে সময় দিবার ইচ্ছায় বহু মহিলা গর্ভাবস্থার শেষ দিনগুলিতেও দফতরে যান। তাঁহাদের অসুবিধার দিকটি কেহ বড় একটা গণ্য করেন না। একটি বাণিজ্যিক সংগঠনের সমীক্ষা বলিতেছে, মাতৃত্ব ও শিশুর পরিচর্যার জন্য ৩৭ শতাংশ মহিলা কর্মী মাঝপথে কাজ ছাড়িয়া দেন। শিশুকে মাতৃদুগ্ধ দানের প্রয়োজনের কথাও স্বাস্থ্য কর্তারা বার বার বলিতেছেন। অতএব বাড়তি ছুটি প্রয়োজন ছিল, সন্দেহ নাই। সরকারের টনক বিলম্বে নড়ে, ইহাই দস্তুর।
টনক নড়িবার অন্য একটি কারণও থাকিতে পারে। ভারতে মাত্র ২৭ শতাংশ মহিলা ‘কর্মী’ বলিয়া গণ্য হন সরকারি নথিপত্রে। অথচ ১৯৯০ সালে কর্মী ছিলেন ৩৫ শতাংশ। নানা বিশ্লেষণে স্পষ্ট হইয়াছে, উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের উপস্থিতি বাড়িলেও শিক্ষিত মেয়েরা কাজের সুযোগ পান নাই। সামাজিক আচার-রীতি তাহার একটি কারণ। বিশেষত সংসার ও সন্তানপালনকে প্রাথমিক গুরুত্ব দিবার অভ্যাস বহু মেয়েকে গৃহবন্দি করিয়াছে। ইহারা অনেকে স্বেচ্ছাবন্দি। মহিলাদের গৃহবন্দিত্বকে পরিবারের সম্মানের সূচক মনে করিবার প্রথাটিও এক অনতিক্রম্য বাধা। যে মেয়েরা ইহার মধ্যেও কাজ করেন, তাঁহারা মাতৃত্বের ছুটির স্বল্পতার কারণে কাজ ছাড়িতে, অথবা বিনা বেতনে ছুটি লইতে বাধ্য হইলে তাহা দেশের পক্ষেও লজ্জাজনক। তবে স্বাস্থ্য বা শ্রমের সামগ্রিক চিত্রের নিরিখে ইহা অল্পই হইল। বাড়তি ছুটির এই আশ্বাস কেবলমাত্র সংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা কর্মচারীদের জন্য। কিন্তু ভারতে দশ জন মহিলা কর্মীর নয় জন অংসগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করিতেছেন। তাঁহারা তুলনায় দরিদ্র ঘরের মেয়ে, সরকারি সুবিধায় তাহাদেরই অগ্রাধিকার। কিন্তু তাঁহাদের নিকট শিশুপালনের সুরক্ষা বা সুবিধা পৌঁছাইবার উপায় সরকারের নাই। অপর দিকে, শিশুদের কেবল স্তন্যপানের দ্বারা অপুষ্টি, উদরাময় প্রভৃতি রোগ হইতে সুরক্ষিত করিতে চাহে স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু কর্মরতা মায়ের সময়াভাবই স্তন্যদানে অক্ষমতার কারণ নহে। কৃত্রিম দুগ্ধ রুখিতে নানা স্তরে উদ্যোগ প্রয়োজন।
অনেকেই সরকারের নিকট প্রশ্ন তুলিয়াছেন, পিতৃত্বের ছুটি কি প্রয়োজন নাই? তাঁহাদের বক্তব্য, মা-ই কেবল সন্তানপালন করিবেন, সরকার এমন প্রত্যাশা করিবে কেন? পুরুষকর্মীদের পিতৃত্বের ছুটি দিলে স্পষ্ট সংকেত যাইবে, তাঁহাদেরও সদ্যোজাতের দেখাশোনা করা কর্তব্য। যুক্তিতে ভুল নাই। তবে তথ্য অন্যরূপ সাক্ষ্য দিতেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, পিতৃত্বের ছুটি থাকিলেও তাহা লইয়াছেন মাত্র ১২ শতাংশ। আর তাঁহাদেরও একটি বড় অংশ সন্তানের পরিচর্যা না করিয়া সে ছুটি কাজে লাগাইয়াছেন গবেষণাপত্র প্রকাশ করিতে। মহিলারা কিন্তু গবেষণা করিতে পারেন নাই। ফলে বিদেশে মহিলা-পুরুষ বৈষম্য কমাইতে পারে নাই পিতৃত্বের ছুটি। কেবল আদর্শ না দেখিয়া কার্যকারিতা বিচার করিয়া সিদ্ধান্ত লইতে হইবে সরকারকে।