প্রবন্ধ ২

ছাত্র আন্দোলন বিষয়ে কিছু অপ্রিয় সত্য

প্রতিবাদকে মোটেও ছোট করছি না। কিন্তু লেখাপড়ার খরচটা সরকারি তহবিল থেকে মেটানো না হলে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের ক্ষতি করে এত আন্দোলন করত কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার নয় কি?যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে নানা আলোচনা পড়ছি, শুনছি। সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে দেশেবিদেশে অনেকের মতামত জেনেছি আমরা। সেই সব বিতর্কের মধ্যে না গিয়েও আন্দোলনের পিছনে অর্থনীতির কতকগুলো বহুচর্চিত যুক্তি কাজ করে কি না, তা নিয়ে এই লেখা। এই পত্রিকায় অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তীর একটি লেখা (‘এই সমস্যা...’, ৩০-৯) এবং সেই সম্পর্কে অধ্যাপক গৌতম ভদ্রের মন্তব্য (‘সে দিনের...’, ৮-১০) পড়েছি।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

প্রতিবাদের ভাষা। উপাচার্যের পদত্যাগ প্রশ্নে গণভোট। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ৩১ অক্টোবর

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে নানা আলোচনা পড়ছি, শুনছি। সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে দেশেবিদেশে অনেকের মতামত জেনেছি আমরা। সেই সব বিতর্কের মধ্যে না গিয়েও আন্দোলনের পিছনে অর্থনীতির কতকগুলো বহুচর্চিত যুক্তি কাজ করে কি না, তা নিয়ে এই লেখা। এই পত্রিকায় অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তীর একটি লেখা (‘এই সমস্যা...’, ৩০-৯) এবং সেই সম্পর্কে অধ্যাপক গৌতম ভদ্রের মন্তব্য (‘সে দিনের...’, ৮-১০) পড়েছি। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্বকে খানিকটা ‘খাটো’ করে দেখানোর জন্য অধ্যাপক চক্রবর্তী কিছু সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, মার্কিন মুলুকে আরও বেশি ছাত্র-আন্দোলন হওয়া উচিত ছিল। ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার ব্যাপারে ছাত্রদের ব্যক্তিস্বার্থ সংবলিত কিছু যুক্তিবাদী সিদ্ধান্তের কথা এ প্রসঙ্গে উঠে আসেনি।

Advertisement

আমাদের যে কোনও ধরনের সিদ্ধান্তের পিছনে লাভক্ষতির একটা হিসেব থাকেই। অনেক সময় অনেক আপাত-মহান কাজকর্মের মধ্যে নিহিত ব্যক্তিস্বার্থের হিসেবনিকেশ অস্বীকার করা উচিত নয়। কিন্তু আমাদের বৌদ্ধিক ট্র্যাডিশন এই স্বার্থের যুক্তিকে অনেক সময় অস্পৃশ্য বলে মনে করে, ধরেই নেওয়া হয় যে, ‘আন্দোলন’ ‘ধর্মঘট’ ‘অবরোধ’ ‘বিক্ষোভ’, এ সবই সামাজিক সচেতনতার মহান অভিব্যক্তি। হয়তো তা-ই। কিন্তু কেউ আন্দোলন-প্রবণতাকে একটু অন্য ভাবে দেখতেই পারেন।

সরকারি অত্যাচারের প্রতিবাদে আমরা ধর্মঘট করতে পারি। কিন্তু যে দিন ধর্মঘট পালন করব, সে দিন আমাদের কিছু একটা ক্ষতি স্বীকার করতেই হবে, তা না হলে ধর্মঘট করে আমরা কাজে ফাঁকি দেব, তাতে আমাদের লাভই হবে। তাই, ধর্মঘটের সময় সরকারি কর্মচারীদের মাইনে কাটা গেলে বোঝা যায়, কারা সত্যি ধর্মঘট করতে চাইছেন আর কারা নিছক মজা দেখতে হুজুগে মেতেছেন। এ ধরনের শাস্তি সব সময় কাজ করতে না-ই পারে, কারণ ধর্মঘটের বা প্রতিবাদের প্রয়োজন ব্যক্তিস্বার্থের পরিধিকে ছাপিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এ যুক্তি অনস্বীকার্য যে, যদি দু’টি দেশের একটিতে ধর্মঘটে মাইনে কাটা হয় না আর অন্যটিকে মাইনে কাটা যায়, তা হলে দ্বিতীয় দেশটিতে ধর্মঘটের একটা বাড়তি প্রবণতা দেখা যাবে। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি অফিসগুলোতে বর্তমান জমানায় ধর্মঘটের প্রবণতা কমে আসার সঙ্গে ওই মাইনে কাটার ব্যাপারটার একটা গভীর সম্পর্ক আছে।

Advertisement

মার্কিন মুলুকে, বা এখন এ দেশেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশুনোর খরচ সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেকটাই বেশি। আমাদের দেশে উচ্চমানের প্রায় সব শিক্ষালয় সরকারি সাহায্যপুষ্ট, টিউশন ফি বাবদ খরচ প্রায় নেই বললেই হয়। ছাত্রছাত্রীরা প্রাইভেট টিউশন বাবদ মাসে বেশ কয়েক হাজার টাকা খরচ করতে রাজি থাকেন, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে একটু বেশি মাইনের কথা বললেই সবাই আন্দোলনে নামবেন বলে হুমকি দেন। আমাকে যদি পড়াশুনো বাবদ বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজকে বেশ খানিকটা টাকা দিতে হয়, তা হলে আন্দোলনের কারণে দিনের পর দিন ক্লাস না হলে আমার আখেরে ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে এমন একটা ধারণা আমার মনে পোক্ত হওয়া স্বাভাবিক। অর্থনীতির পরিভাষায় একে ‘অপরচুনিটি কস্ট’ আখ্যা দেওয়া হয়। আমি যদি শিক্ষা বাবদ হাজার হাজার টাকা বিনিয়োগ করি, তা হলে যত নির্ঝঞ্ঝাটে শিক্ষা লাভ করে আমি সেই বিনিয়োগ থেকে মুনাফা করতে পারব, ততই মঙ্গল। বিশেষ করে যদি আমাকে ঋণ করে শিক্ষার খরচ চালাতে হয়। মার্কিন মুলুকে বা যে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার খরচ অপেক্ষাকৃত বেশি এবং ঋণ-নির্ভর, সেখানে আন্দোলনের জোয়ারে খানিকটা মন্দা থাকবেই। আমাদের সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষায় সেই চাপটা নেই।

প্রসঙ্গত, দীপেশ চক্রবর্তীর লেখায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বনাম মানববিদ্যা চর্চার প্রসঙ্গে একটা সমতুল মন্তব্য করা হয়েছে। ‘পরে করে নেব’ এমন একটা উপায় যদি কারও থাকে, সেই গোষ্ঠীর মধ্যেও আন্দোলনের স্পৃহা তুলনায় বেশি হবে। যে ধরনের বিষয়ে এই ‘পরে করে নেব’ ব্যাপারটা অতটা সোজা নয়, সেখানে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার, শেষ বর্ষে যাঁরা পড়ছেন, যাঁদের কিছু দিনের মধ্যেই চাকরির প্রয়োজন, তাঁদের মধ্যেও ‘প্রতিবাদী’ চরিত্রের চেহারাটা প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের চেয়ে ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। অর্থাৎ, আন্দোলন করে আমার কী ক্ষতি হচ্ছে, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা আন্দোলন, ক্লাস না-করা, অবরোধ-মিছিলে শামিল হওয়া এ সব ক্রিয়াকলাপকে নিঃসন্দেহে খানিকটা প্রভাবিত করে। সরকারকে প্রতি ছাত্রছাত্রী বাবদ যে-বিশাল পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়, সে বিষয়ে আমরা সজাগ নই। আর তেমন কোনও আর্থিক দায় নেই বলেই প্রতিবাদী আন্দোলন, অবরোধ ইত্যাদি খানিকটা ‘শস্তা’ ভোগ্যপণ্যের মতো যথেচ্ছ ব্যবহার করতে কোনও অসুবিধে নেই। লক্ষণীয়, আজ যে ছাত্রছাত্রীরা নামী-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েন, তাঁদের অনেকেই সমাজের বিত্তশালী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা কলেজে ঢোকার আগে স্কুলে কী মাইনে দিতেন বা প্রাইভেট টিউশনে কতটা খরচা করতেন কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তি-শিক্ষার সুযোগ না পেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কী অঙ্কের মাইনে দিয়ে পড়তেন, তার পরিসংখ্যান পাওয়া শক্ত নয়। কিন্তু কেউ তা দেখতে চান না, কারণ সে-সব নিয়ে কথা বলা রাজনৈতিক ভাবে সঠিক নয়। কারও পক্ষেই নয়। শিক্ষার বাজার দরের সঙ্গে শিক্ষালাভের যে মূল্য, তার কোনও সম্পর্ক না থাকলে অনেক সমস্যা হয়। অতিরিক্ত আন্দোলন, বিক্ষোভ, অবরোধ তার মধ্যে একটি।

প্রতিবাদকে অবমাননার অভিপ্রায়ে এ বক্তব্য পেশ করছি না। আজ সারা বিশ্বে বিভিন্ন জায়গায় গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন ও আত্মত্যাগের ঝড় উঠেছে। কিন্তু যে সব দেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত, সেখানে সব রকম গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে গভীর আদর্শপ্রসূত, তা বলা চলে না। কোম্পানির মালিকেরা ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের দিয়ে বাজারে মন্দার সময় ‘ধর্মঘট’ করাতে পারেন, এ কথা অজানা নয়। সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ ছবি স্মরণীয়। অনেক আপাত-মহৎ বিক্ষোভ-বিরোধের পিছনে আর্থিক এবং স্বার্থপুষ্ট ভালমন্দ, ক্ষয়ক্ষতির হিসেব বিদ্যমান। যুক্তি দিয়ে এই দিকটা খোলাখুলি আলোচনায় অনেকের আপত্তি, কারণ আমাদের বৌদ্ধিক ট্র্যাডিশন মূলত বিপ্লববাদী। আর সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চরম ভর্তুকির অর্থনীতি আমরা সবাই যে বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ দিয়ে পুষ্ট করে চলেছি, সেটা জনসমক্ষে আনার ব্যাপারে স্বভাবতই আমরা অনুৎসাহী।

খানিকটা গাত্রদাহ হলেও গণতন্ত্রে সমালোচনা আমাদের সহ্য করতেই হয়। ‘রাজনৈতিক ভাবে বেঠিক’ মন্তব্য বারে বারে আলোচিত না হলে একপেশে মত প্রকাশকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতিফলন বলে ভুল করি আমরা। আন্দোলনের যতটুকু আদর্শপ্রসূত, সেটা, কিংবা যাঁরা সত্যিই আদর্শের জন্য নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত, তাঁরাও জনতার ভিড়ে হারিয়ে যান। আন্দোলনের দর-দাম সঠিক হলে নিঃসন্দেহে আন্দোলন অনেক কম দেখতাম আমরা।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন