প্রবন্ধ ১

ছড়ি ঘোরাবেন না

সরকার টাকা দিচ্ছে বলে দলের কথায় চলতে হবে, এই নির্বোধ দাবি করলে আর যা-ই হোক, বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে না।গ ত দেড় মাস ধরে কেন্দ্র ও রাজ্য পরিচালিত বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের নাম বারংবার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটের বর্তমান চেয়ারম্যান গজেন্দ্র চৌহান, (কলকাতা) আইএসআই-এর সদ্য-প্রাক্তন ডিরেক্টর বিমল রায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য সুগত মারজিৎ এবং কলকাতার প্রাক্তন ও যাদবপুরের বর্তমান উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে এক বন্ধনীতে মেলানোর আপাত কোনও পরিসর নেই।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share:

গ ত দেড় মাস ধরে কেন্দ্র ও রাজ্য পরিচালিত বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের নাম বারংবার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটের বর্তমান চেয়ারম্যান গজেন্দ্র চৌহান, (কলকাতা) আইএসআই-এর সদ্য-প্রাক্তন ডিরেক্টর বিমল রায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য সুগত মারজিৎ এবং কলকাতার প্রাক্তন ও যাদবপুরের বর্তমান উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে এক বন্ধনীতে মেলানোর আপাত কোনও পরিসর নেই। যে সব কারণে এই চার জনের নাম ইদানীং শোনা যাচ্ছে, সেই বিষয়গুলোর মধ্যেও যোগ প্রায় নেই। এঁদের নাম জড়িয়ে যে সব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোও ভিন্ন প্রকৃতির। যেমন, গজেন্দ্রকে প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা প্রধান হিসেবে চান না, বিমলদার জন্যে বর্তমান ও আমার মতো প্রাক্তন ছাত্ররা— জান কবুল আর মান কবুল।
কিন্তু এই ঘটনাগুলোকে একটা সূত্রে গেঁথে ফেলা যায়। সূত্রটা হল (উচ্চ)শিক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলির, তথা রাজনীতির বা সরকারের ভূমিকা। আমরা সকলেই চাই, অন্তত মুখে বলি, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতিমুক্ত হোক, রাজনীতিকরাও মাঝে মাঝেই এ হেন সদিচ্ছা প্রকাশ করে বসেন। কিন্তু সমস্যাটা যে ঠিক কী, তার গোড়াটা কোথায়, কী ভাবে তা উৎখাত করা সম্ভব, সে নিয়ে কথা বা ভাবা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি সরে যাক বলতে আমরা বড় জোর বুঝি, ক্যাম্পাসে যেন রাজনৈতিক সভা না বসে, ছাত্রছাত্রীরা দাঙ্গা না বাধায়, ‘বহিরাগত’রা না আসে, শিক্ষক নিগ্রহ বন্ধ হয়, পুলিশ না ডাকতে হয়। তা হলেই যেন প্রতিষ্ঠানগুলি সুন্দর থেকে সুন্দরতর হবে।
এগুলো কিন্তু রোগের প্রকাশ মাত্র, গায়ে জ্বর আসার মতো। প্যারাসিটামল খেয়ে সাময়িক ভাবে জ্বরের উপশম হয়, রোগ সারে না। সমস্যাটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকায়। কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, যে রঙের দলই ক্ষমতায় থাকুক, রোগ একই। রোগটা হল উচ্চশিক্ষায় সরকারি অধিকার ও আধিপত্য ফলানো।

Advertisement

নতুন কিছু বেসরকারি উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র বাদ দিলে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা মোটের উপর সরকারি। অর্থাৎ, রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সংসার চলে, শিক্ষক-অশিক্ষক সব কর্মী বেতন পান। এখান থেকেই গোলমালের সূত্রপাত। স্বাধীনতা-উত্তর আজ পর্যন্ত সব ক’টি রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গি এক। ক্ষমতায় এলে সব দলই মনে করে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর কাজটাও সরকারের, তা সে যতই ‘স্বশাসিত’ হোক না কেন। ‘আমরা টাকা দিচ্ছি, অতএব আমরা করব না তো কে করবে?’ রাজনীতিকদের এই বদ্ধমূল ধারণাটা আমাদের মনেও গেঁথে গেছে। কলেজের লেকচারার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত সকলেই নিজেদের সরকারি চাকুরে ভাবেন, সরকারের মর্জিমতে তাই তাঁদের চলতে হয়। না চললে শাস্তির ব্যবস্থা: পুলিশ বা ব্যাঙ্ককর্মীদের মতো অধ্যাপকদেরও সরকার বদলির চিঠি পাঠাতে পারে। অতএব, এই মডেলটাই যে আদতে ভুল, সে কথা ভাবার বা বলার কারও সুযোগ হয় না। গলদ আমাদের দেশের মানসিকতার একেবারে গোড়ায়। গোটা ব্যবস্থাটাই সেই ছকে বাঁধা। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হবেন রাজ্যের রাজ্যপাল, আই এস আই-এর মতো বিশ্ববন্দিত শিক্ষাকেন্দ্রেরও চেয়ারম্যান হবেন অরুণ শৌরীর মতো কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী (এর আগে ছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়)।

বিলেতে, ইউরোপে, আমেরিকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের টাকা পায়, কিন্তু সেখানে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় চালায় না। যেমন ধরুন আমেরিকার ‘স্টেট ইউনিভার্সিটি’গুলি— যাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই আসে সেই স্টেটের সরকারের ভাঁড়ার থেকে, জনগণের দেওয়া ট্যাক্স জমিয়ে। কিন্তু কখনও শুনেছেন, কোনও স্টেটের গভর্নর পদাধিকারবলে সেই স্টেটের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন? আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানরা প্রায় সকলেই আগে অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-অধ্যাপক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর জন্যে তার প্রেসিডেন্টকে পদে পদে সরকারি আমলা বা মন্ত্রীর মতামত গ্রাহ্য করতে হয় না। বিলেতের গল্পও তদনুরূপ। বিলেতের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের সিংহভাগ আসে সরকারি উচ্চশিক্ষা খাতে। এই সে দিনও নাগরিকদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষা ছিল বিনামূল্যের, বছর কয়েক আগে বিলেতের সরকার বার্ষিক ফি চালু করে, ছাত্রছাত্রীরা চাকরি পেয়ে যা কর হিসেবে শোধ করে দেবে। কিন্তু অনুদান বা কর, সরকারি নীতি যা-ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয় চালান উপাচার্য, যিনি কোনও মতেই রাজনীতির লোক নন। মাথার উপর সৌন্দর্যবর্ধক আচার্য আছেন বটে, তবে সচরাচর রাজনীতির ছোঁয়া বাঁচিয়েই তাঁদের নিয়োগ করা হয়। যেমন, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান আচার্য হলেন এক ভারতীয় ব্যবসায়ী— বিয়ার প্রস্তুতকারক লর্ড বিলিমোরিয়া।

Advertisement

উন্নত বিশ্বের উন্নত মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির খ্যাতির মূলে রয়েছেন সেখানের শিক্ষক-অধ্যাপকেরা। এঁদের মূল কাজ গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানরা ভাল শিক্ষক-গবেষকদের টেনে আনেন এবং পুষে রাখেন। শিক্ষকের পারিশ্রমিকও নির্ভর করে গবেষণার ওপর, গবেষক হিসেবে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের পেছনে অঢেল অর্থ ঢালতে রাজি হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, সেই অর্থ সরকারি বা বেসরকারি, যে খাতেই আসুক। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার থেকে প্রফেসর সবাইকেই গবেষণা ও ক্লাসে পড়ানো ছাড়াও আর একটা কাজ করতে হয়। অ্যা়ডমিনিস্ট্রেশন বা প্রশাসন পরিচালনা। স্বল্প মাত্রায় সবাই মিলে কাজটা করেন বলেই বিশ্ববিদ্যালয় স্বশাসিত ও সুশাসিত হয়। এই কাজে পারদর্শীরাই কালক্রমে আমেরিকায় ডিন বা প্রোভস্ট বা প্রেসিডেন্ট হন, বিলেতে প্রো-ভিসি বা ভিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে তাই সরকারের নাক গলাতে হয় না। রাজনৈতিক দলের ইচ্ছের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বাছাই করতেও হয় না।

আমাদের নেতারা বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বিশ্বমানের হোক। অথচ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নিজের মতো করে চলতে দেওয়া হয় না। তাঁদের অনেকেই বিদেশের প্রধানদের মতো গুণী ও পারদর্শী, ইচ্ছে করলেই বিদেশে থেকে যেতে পারতেন, হয়তো এক দিন সেখানেও উপাচার্য হতে পারতেন। দেশে ফিরে এসেছেন, এটা আমাদের কাছে সৌভাগ্য। ভয় লাগে, দেশের রাজনীতির চাপে তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরি আমাদের প্রজন্মের হয়তো কেউই থাকবেন না। তখন, ইচ্ছে না থাকলেও মৃণাল সেনের অভাবে গজেন্দ্র চৌহানকেই মেনে নিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের মতো চলতে দিন। জনগণের টাকা নিয়ে চলছে বলেই রাজনীতিকদের বা রাজনৈতিক দলের কথায় চলবে, এই নির্বোধ দাবি করলে আর যা-ই হোক, বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে না।

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন