প্রবন্ধ ২

জাতীয় আয় হঠাৎ এতটা বেড়ে গেল, Zানতি পারলাম না?

বিনিয়োগের হার তেমন বাড়েনি, অথচ জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি হঠাৎ অনেকখানি বেড়ে গেল! তবে কি আমরা রাতারাতি খুব উৎপাদনশীল হয়ে উঠলাম?দিল্লি নির্বাচনে বিজেপি পর্যুদস্ত হওয়ার পরে খানিকটা বাধ্য হয়েই অর্থমন্ত্রী গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে কাটছাঁট করতে পারলেন না, যদিও মূল্যবৃদ্ধির হার মাথায় রাখলে, যে টাকাটা বরাদ্দ হয়েছে তার প্রকৃত মূল্য আগের বছরের বরাদ্দের চেয়ে কম হতেই পারে। একই সঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান প্রকল্পে, মহিলা ও শিশু বিকাশ প্রকল্পে বরাদ্দ বিশেষ ভাবে কমে এসেছে।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share:

দিল্লিতে সে দিন বাজেট। কলকাতা, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। ছবি: রয়টার্স।

দিল্লি নির্বাচনে বিজেপি পর্যুদস্ত হওয়ার পরে খানিকটা বাধ্য হয়েই অর্থমন্ত্রী গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে কাটছাঁট করতে পারলেন না, যদিও মূল্যবৃদ্ধির হার মাথায় রাখলে, যে টাকাটা বরাদ্দ হয়েছে তার প্রকৃত মূল্য আগের বছরের বরাদ্দের চেয়ে কম হতেই পারে। একই সঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান প্রকল্পে, মহিলা ও শিশু বিকাশ প্রকল্পে বরাদ্দ বিশেষ ভাবে কমে এসেছে। পাশাপাশি, সবার জন্য জীবন ও দুর্ঘটনা বিমা প্রকল্পে সবার খানিকটা যোগদান একটি ভাল পদক্ষেপ। পরিকাঠামোজনিত খরচা তুলতে বন্ড বাজারে ছাড়ার নীতিটিও প্রশংসনীয়। সোনার স্থানীয় চাহিদা বাড়ানোর ধারণাটি ভাল।

Advertisement

কর্পোরেট ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে করের হার বেশি হলে কম করাটা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এ দেশে কর ফাঁকি দেওয়ার অনেক রাস্তা থেকে যায়, সরকার বলছে, কর সম্পর্কিত বিশেষ ছাড় বা আইনের সরলীকরণের মাধ্যমে ওই সব রাস্তা বন্ধ করা হবে, যাতে শুধু শুধু সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে কর না দেওয়ার ফন্দি করা না যায়। প্রশ্ন হল, কর্পোরেট দুর্নীতি কি নিয়ন্ত্রিত হবে? যতক্ষণ অসংগঠিত ক্ষেত্রে টাকা খাটানোর সুদ, আইনানুগ ক্ষেত্রে টাকা খাটানোর সুদের চেয়ে বেশি হবে— ঘুরপথে বা কালো পথে কর ফাঁকি চলবেই, তা না হলে বড় বড় কোম্পানিদের সরকারি ব্যাংকে এত টাকা ঋণ আদায় করা সম্ভব হবে না। বাস্তব পরিস্থিতিকে মাথায় রাখলে, এগুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা না হলে মনে হতেই পারে যে, অন্য কোনও কারণে কর্পোরেট ক্ষেত্রকে বিশেষ সুবিধে দেওয়া হচ্ছে।

রাজ্যগুলোকে অতিরিক্ত রাজস্বের ভাগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কেন্দ্রীয় প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হল এবং রাজ্যকে দিয়ে দেওয়া হল। আগে এই বাবদ কেন্দ্রীয় খরচা এবং রাজস্বের ভাগ মিলিয়ে রাজ্যগুলো যা পেত, এখনও মোটামুটি তা-ই পাবে। ফলে, এক হাতে দিয়ে অন্য হাতে নিয়ে নেওয়া হল। অনেক রাজ্যের খরচায়, যেমন পশ্চিমবঙ্গে তেমন কোনও বাড়তি সুবিধে হবে বলে মনে হয় না। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বিকেন্দ্রীকরণের নীতি বাস্তবে কিছুটা ধাক্কা খেল বইকী। তবে বারে বারে খরচার জন্য কেন্দ্রকে আর্জি করার জন্য যে সময়ের অপচয়, সেটা কমবে। শোনা যাচ্ছে, বিহারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের জন্য বিশেষ কেন্দ্রীয় অনুদান (বিআরজিএফ) অক্ষত থাকবে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তেমন কোনও আশা নেই। আর বিগত রাজ্য সরকারের চরম গাফিলতির জন্য এফআরবিএম আইন খুব দেরিতে কার্যকর হওয়ায় যে অসীম ঋণভার রাজ্য সরকার বইছে এবং কেন্দ্রকে গত তিন বছরে মোটামুটি ৮০ হাজার কোটি টাকার উপর যে সুদ দিতে হয়েছে, তার তুলনায় এককালীন ৮৫০ কোটি টাকা নিতান্তই নগণ্য।

Advertisement

বলা হচ্ছে, এই বাজেট আয়বৃদ্ধিতে উৎসাহ দেবে এবং সব বর্গের মানুষ সেই আয়বৃদ্ধির ফসল কুড়োবেন। আয়বৃদ্ধি কতটা উৎসাহিত হবে? কোনও বাজেটই যুগান্তকারী ফল দিতে পারে না। ১৯৯১-৯২-এর মতো ব্যতিক্রমী বছরের কথাটা আলাদা। যে কোনও সময়ে যে কোনও দেশে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার নির্ভর করে বিনিয়োগের হার এবং উৎপাদনশীলতার ওপর। এ দেশে বিনিয়োগের হার, বিশেষ করে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের হার যে মোটেই আশাপ্রদ নয়, সেটা কর্পোরেট ক্ষেত্রে করের হার বেশি বলে, না সুদ বেশি বলে? গভীর গবেষণা বলে এবং অনেক দিন থেকেই বলে যে, সুদের হারের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সামগ্রিক বিনিয়োগের হারের সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। নিঃসন্দেহে পরিকাঠামোর ভূমিকা আছে। এবং সরকারের টাকার প্রয়োজন, বেসরকারি বিনিয়োগও প্রয়োজন। এ সরকার ব্যবসা এবং ব্যবসায়ীর গুরুত্ব বেশি বোঝেন, সেটা ভাল কথা। কিন্তু তা বলে লোক দেখানো জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার কিংবা রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনুদান ছাঁটাই বাবদ কত টাকা রাজ্য আসলে পাচ্ছে না, সেটা পরিষ্কার করে না বলা, অথবা শিক্ষা ক্ষেত্রকে বা মহিলা ও শিশু উন্নয়নকে উপেক্ষা করার মতো পদক্ষেপ শোভা পায় না।

তবে বাজেট পেশ করার ঠিক আগেই কেন্দ্রীয় সরকার রাতারাতি আমাদের দেশের জাতীয় আয় অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। আয় বেড়েছে খাতায়-কলমে, এই যা। এবং কেমন ভাবে বেড়েছে? আগে ২০০৪-০৫ সালের আয়ের স্তরকে মাথায় রেখে বাস্তব আয়ের পরিমাণ ঠিক হত, হঠাৎই সেই ভিত্তিবর্ষটা হয়ে গেল ২০১১-১২। কেন হল, তা খোলসা করে কিছুই বলা হল না। তা ছাড়া আগে উৎপাদনের উপাদানগুলি কত রোজগার করছে বা সেই বাবদ কত টাকা খরচা হচ্ছে, সেই অনুসারে আয় মাপা হত। এখন বাজারের দাম অনুযায়ী হচ্ছে। ভাল কথা, কিন্তু ২০১১-১২ সালের দামের স্তর ধরার জন্যেই জাতীয় আয় এতটা বেড়ে যেতে পারে। উৎপাদনের উপাদানের আয়ের সঙ্গে পরোক্ষ কর যোগ করে বাজারের দাম নির্ধারিত হয়। কেউ বলতে পারেন ২০০৪-০৫-এর বদলে ২০১১-১২’কে খুঁটি ধরার ফলে পরোক্ষ কর এবং ভর্তুকির মাত্রায় এমন হেরফের হয়ে গেছে, অন্তত আগের বছরের তুলনায়, যাতে বাজারের দাম দিয়ে জাতীয় আয় মাপলে আর উৎপাদনের উপাদানের আয় দিয়ে মাপলে এক বিশাল ফারাক হচ্ছে এবং জাতীয় আয় বেশি দেখাচ্ছে।

সভ্য দেশ হলে এ নিয়ে খানিকটা বিতর্কের পর, শ্বেতপত্র প্রকাশের পর তবে এই পরিবর্তন কার্যকর করা হত। কিন্তু তা হয়নি। জাতীয় আয় ঠিক ভাবে নির্ধারণ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফে কোনও কমিটি হলে ভাল হত। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রাজনৈতিক কোনও উদ্দেশ্য থাকার কথা নয়। সরকারের তেমন উদ্দেশ্য থাকতেই পারে। মনে রাখতে হবে, জাতীয় আয় বেড়ে গেলে, জাতীয় আয়ের অনুপাত হিসেবে রাজকোষ ঘাটতি বা বাণিজ্য ঘাটতি, দুটোই কম দেখাবে। ফলে সরকারের মুন্সিয়ানা প্রকাশ পাবে এবং সরকার আরও ধার করতে সক্ষম হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সুদ কমানোর চাপ সৃষ্টি করবে। আর যদি বিদেশের আর্থিক ভাবে উচ্চ বর্ণের লোকজনকে দেখানোটাই উদ্দেশ্য হয় যে আমরা চিনের চেয়ে দৌড়ে এগিয়ে, তা হলে এ দেশের শিল্প এবং শিল্পজাত রফতানির এই অবস্থা কেন? চিনের চেয়ে শুধু পিছিয়ে থাকা নয়, একেবারে হতদরিদ্র অবস্থা আমাদের শিল্পে।

পরিশেষে আবার অর্থনীতির কথায় ফিরে আসি। জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারের বিখ্যাত সর্বজনগ্রাহ্য ফর্মুলাটি হল: বৃদ্ধির হার= বিনিয়োগের হার × সামগ্রিক উৎপাদন ক্ষমতা (বা উৎপাদনশীলতা)-র হার। হঠাৎ করে বৃদ্ধির হার বাড়তে পারে, যদি বিনিয়োগের হার বেড়ে যায় বা উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায়। যতই আমরা ভিত্তিবর্ষ পাল্টাই বা অন্য ভাবে জাতীয় আয় মাপি, এই ফর্মুলাটি মাথায় রাখতেই হবে। আমি নিশ্চিত, আমাদের বিনিয়োগের হার তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তা হলে কি আমরা হঠাৎই ভীষণ উৎপাদনশীল হয়ে গেলাম? Zানতি পারলাম না?

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন