রাজনীতিতে শেষ কথা বলিয়া কিছু হয় না, কারণ রাজনীতি স্বভাবত গতিশীল। এই গোড়ার কথাটি মনে রাখিলে নরেন্দ্র মোদীর প্রচার অভিযানের অর্থ বুঝিয়া লওয়া সহজ হয়। মোদী সম্পর্কে তাঁহার অনুগামীদের অনুরাগ এবং তাঁহার প্রতিপক্ষের বিরাগ, দুইই প্রবল। দুই তরফের নিরন্তর বিবাদের তীব্রতা তাহারই প্রমাণ। কিন্তু এই চরমপন্থী সওয়াল-জবাবের তাড়নায় গতিশীল এবং পরিবর্তমান রাজনীতির গভীর সত্যটি হারাইয়া যাইতেছে। অথচ নরেন্দ্র মোদীর প্রচার-প্রতিমার সৃষ্টি ও বিবর্তনে সেই সত্যের তাত্পর্য বিপুল। মোদী কী ছিলেন, কী হইয়াছেন এবং সত্য সত্যই কী হইতে চাহেন, সেই বিষয়ে বহু বিতর্ক আছে, থাকিবে। কিন্তু তিনি বা তাঁহার সতীর্থরা তাঁহার ভাবমূর্তিকে কোথায় পৌঁছাইয়া দিতে ব্যগ্র, রাজনীতির পাঠে সেই প্রশ্নটি বিশেষ মূল্যবান। মূল্যবান এই কারণে যে, তাহা ভারতীয় গণতন্ত্রের বাস্তবকে চিনাইয়া দেয়। সেই বাস্তবের মোকাবিলা করিয়া ভোট আদায়ের তাগিদেই তো মূর্তি গড়িবার উদ্যোগ!
গুজরাত ২০০২ হইতে ভারত ২০১৪ স্থান এবং কাল ব্যাপিয়া নরেন্দ্র মোদীর অভিযানে কোনও একটি শব্দ যদি নিরন্তর ছায়া ফেলিয়া থাকে, তাহার নাম রাজধর্ম। বারো বছর আগে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী রাজধর্ম হইতে বিচ্যুত হইয়াছিলেন। আইন-আদালতের বিচারে তাঁহার কোনও অপরাধ প্রমাণিত না হইলেও সেই বিচ্যুতির নৈতিক দায় হইতে তিনি অব্যাহতি পাইবেন না, কারণ রাজ্যের মানুষকে মুসলমান মানুষকেও নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁহারই। এই ধর্মচ্যুতি তাঁহাকে আপন রাজ্যে কোনও সমস্যায় ফেলে নাই। কিন্তু রাজনীতি গতিশীল। মোদী যে মুহূর্তে রাজ্য ছাড়াইয়া জাতীয় রাজনীতিতে পা রাখিতে চাহিলেন, গুজরাত ২০০২ তাঁহার সম্মুখে বাধাস্বরূপ আসিয়া দাঁড়াইল। অতঃপর সেই বাধা দূর করা তাঁহার প্রধান লক্ষ্য। তাঁহার নির্বাচনী প্রচারের ধারা লক্ষ করিলে দেখা যাইবে, তিনি এই লক্ষ্য পূরণের জন্য একটি নির্দিষ্ট উপায় সাব্যস্ত করিয়াছেন। তিনি অবিরাম ঘোষণা করিতেছেন যে, ক্ষমতা হাতে পাইলে কঠোর এবং নিরপেক্ষ প্রশাসন সরবরাহ করাই হইবে তাঁহার কাজ। অর্থাত্ যে রাজধর্ম হইতে বিচ্যুতি তাঁহার কলঙ্ক, মোদী সেই রাজধর্ম পালনকেই নিজের ‘ইউ এস পি’ করিয়াছেন।
এই উদ্যোগের পিছনে রহিয়াছে নির্বাচনী গণতন্ত্রের বাস্তব। তাঁহার দল তথা রাজনৈতিক পরিবারের কুলপতিদের অনেকেই হয়তো রামমন্দির, রামসেতু, সরস্বতীবন্দনা, বৈদিক গণিত, গোমাতা ইত্যাদির ভজনাকেই নির্বাচনী প্রচারের চালিকা শক্তি হিসাবে ব্যবহার করিতে পারিলে আহ্লাদিত হইতেন। কিন্তু সেই পথে যথেষ্ট ভোট আসিবে না। প্রথমত, বহু ধর্ম, বহু জাতি, বহু বর্গে বিভাজিত ভারতীয় সমাজকে রামশিলায় বাঁধানো একঘাটে জল খাওয়ানো কঠিন। কিন্তু আরও বড় সত্য ইহাই যে, সনাতন ভারত এখন অতীত। নূতন ভারত ত্রেতাযুগের পুনরুদ্ধারে উত্সাহী নয়, তাহার দাবি সুশাসন এবং উন্নয়ন। গত দুই দশকের আর্থিক সংস্কার এবং বিশ্বায়ন এই মৌলিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈয়ারি করিয়াছে। তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে জনবিন্যাসের রূপান্তর। অর্ধেক ভারতবাসীর বয়স পঁচিশের নীচে, কার্যত অর্ধেক নাগরিক শহর বা শহরাঞ্চলের অধিবাসী। মন্দির-মসজিদে এই ভারতের অরুচি না থাকিতে পারে, কিন্তু তাহার অগ্রাধিকার অন্য। নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার দলকে সেই অগ্রাধিকারকে মান্য করিতে হইবে। সঙ্ঘ পরিবারের অন্দরমহলে এখনও যে ত্রেতাযুগ বিরাজ করিতেছে, উহাই তাঁহাদের প্রধান সমস্যার কারণ। সেই স্থবিরতার বিরুদ্ধে জঙ্গম রাজনীতির লড়াই চলিতেছে। মোদী তাঁহার অভিযানে সফল হইলেও সেই লড়াই থামিবে না। তখন নিজেকে কেবল প্রচারে নয়, কাজেও রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে প্রতিপন্ন করাই হইবে দলনেতার চ্যালেঞ্জ।