ভারতীয় জনতা পার্টির ‘সাক্ষী মহারাজ’ বলছেন, প্রতিটি হিন্দু রমণীর অন্তত চারটি করে সন্তান প্রসব করা উচিত। বিজেপি নেত্রী ‘সাধ্বী প্রাচী’ও তা-ই মনে করেন। ইতিমধ্যে তিনি উত্তর ভারতে সভা করে মঞ্চে ডেকে এ ধরনের দশপ্রসবিনী মহিলাদের পুরস্কৃতও করছেন। বীরভূমের বিজেপি নেতা শ্যামল গোস্বামীর মতে সংখ্যাটা হওয়া উচিত পাঁচ। তবে বদ্রিকাশ্রমের শংকরাচার্য বাসুদেবানন্দ সরস্বতীর নিদান, চার-পাঁচটায় থামলে হবে না, প্রত্যেক হিন্দু মহিলাকে অন্তত দশটি করে সন্তান উৎপাদন করতে হবে। কারণ, তা না হলে দেশে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রক্ষা করা যাবে না।
মুসলমানরা বেশি সন্তান প্রজননের ফলে সংখ্যাগুরু হয়ে যাবে, এই প্রচারের প্রশ্নে পরে আসছি। তার আগে একটা গোড়ার কথা লক্ষ করা দরকার। হিন্দুত্ববাদীরা নানা দিক থেকে মায়েদের উপর্যুপরি সন্তান প্রজননের আহ্বান জানাচ্ছেন। যেন সন্তান ধারণ এবং জন্মদান খুবই সহজ ও সুললিত একটি প্রক্রিয়া। অথচ সন্তানের জন্ম দিতে মায়েদের মৃত্যুর হার ভারতে এখনও অত্যন্ত বেশি। রাষ্ট্রপুঞ্জের সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি বছর যে ২ লক্ষ ৯০ হাজার প্রসূতির মৃত্যু ঘটে, তার ১৭ শতাংশই একা ভারতে। শতাংশ থেকে সংখ্যায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় বছরে ৫০ হাজার, দৈনিক ১৩৭। নাইজিরিয়ার মতো অনগ্রসর, হতদরিদ্র, সমস্যাদীর্ণ আফ্রিকান দেশের প্রসূতি মায়েদের অবস্থাও এর চেয়ে ভাল। সন্তানজন্ম দিতে গিয়ে ভারতীয় মায়েদের এই গণমৃত্যুর প্রধান কারণ তাঁদের অপুষ্টি। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ১৫ থেকে ৫৫ বছর বয়স্ক ভারতীয় মহিলাদের ৬০ শতাংশই রক্তাল্পতায় ভুগছেন। জন্মের পরেও দেশে ফি-বছর যে ১৩ লক্ষ শিশু মারা যাচ্ছে, তা-ও মায়েদের ওই অপুষ্টির কারণে। সাক্ষী মহারাজ বা শংকরাচার্যরা এই অপুষ্টিক্লিন্ন, রক্তাল্পতায় ভোগা মহিলাদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কথা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের কথা বলছেন না, বলছেন চারটি, পাঁচটি বা দশটি করে সন্তান উৎপাদন করতে, যাতে সনাতন ধর্ম রক্ষা পায়!
মুসলিমরা এক দিন এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে, এই কাল্পনিক শঙ্কার ভিত্তিতেই হিন্দুত্ববাদীদের এমন নিদান। এ কথা ঠিক যে হিন্দুদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার আগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু তার কারণ হিন্দু মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার, যে-শিক্ষা পরিবার সংক্ষিপ্ত রাখার প্রয়োজন সম্পর্কে চেতনা আনে। এক বার সেই চেতনা জাগ্রত হলে পিতৃতন্ত্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার সাহস অর্জিত হয়। যাঁরা সেই সাহস অর্জন করেছেন, শংকরাচার্যের আহ্বানেও আঁতুড়ঘরের অন্ধকারে তাঁরা আর ফিরবেন না। বহুপ্রসবিনী হওয়ার চেয়ে একটি বা দুটি সন্তানকেই ভাল করে বড় করার, তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দিকে ভাল করে নজর দেবার বিকল্প বেছে নেবেন।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সামান্য বেশি। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের দাবি মতো ‘প্রেম জেহাদ’ বা ধর্মান্তরকরণ এর কারণ নয়, তার কোনও প্রশ্নও ওঠে না। এক পুরুষের চার স্ত্রীর শরিয়তি অনুমোদনও এর কারণ নয়। হিন্দুত্ববাদীরা ‘হাম পাঁচ, হমারে পচ্চিশ’ বলে যতই ঘৃণামিশ্রিত বিদ্রুপে কলরবে মাতুক, বাস্তবে চারটি করে বউ খুব মুসলমানেরই থাকে, রাখতে পারে। তর্কের খাতিরে যদি থাকতও, সহজ কাণ্ডজ্ঞানই বলে দেবে যে, তাতে সন্তানসংখ্যার হেরফেরের কোনও কারণ নেই, কারণ সন্তান জননীর গর্ভেই হয়, বিভিন্ন জননী বিভিন্ন পুরুষের স্ত্রী হোন বা একই পুরুষের স্ত্রী হোন। তা ছাড়া, সমস্ত মুসলমানের চারটে করে বউয়ের তত্ত্ব সত্য হলে অধিকাংশ মুসলিমকে মেয়ে ‘কম পড়ায়’ জীবনভর অবিবাহিত থেকে যেতে হত, এটা বুঝতে যেটুকু পাটিগণিত লাগে, সেটা ওই তত্ত্বের প্রচারকদেরও না জানার কথা নয়। আসলে জন্মহার ব্যাপারটা প্রধানত আর্থিক অবস্থা এবং সামাজিক অগ্রগতি, বিশেষত মেয়েদের শিক্ষা, আর্থিক স্বাধীনতা বা সামাজিক অধিকারের মতো ব্যাপারগুলোর উপর নির্ভর করে। পৃথিবীর সর্বত্র সেটা প্রমাণিত। এই দিক থেকে মুসলিম সমাজের একটা বিরাট অংশ এখনও পশ্চাৎপদ, মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা তুলনায় নিচুতে, আর্থিক স্বাধীনতা নেই বললেই চলে, দুই সন্তানের জন্মের মধ্যে সময়ের ব্যবধানও কম, জন্মহারে তারই প্রতিফলন ঘটে। হিন্দুত্ববাদীরা যদি মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির শঙ্কায় এতই আতঙ্কিত হন, তবে মুসলিম সমাজে, বিশেষত মুসলিম মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে তাঁদের রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে বলুন। তবে এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা খেয়াল করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কন্যাভ্রূণহত্যা নামক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি মুসলিম সমাজে বিরল। হিন্দুরা, বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদীদের প্রধান চারণভূমি উত্তর ভারতের হৃদয়পুরের বাসিন্দারা এ বিষয়ে মুসলমানদের অনুকরণ করতে পারেন, মেয়েগুলো বাঁচবে।
হিন্দু নারীদের উচ্চফলনশীল করে তোলার উদ্যোগে ফিরে আসা যাক। তাঁদের বহুপ্রসবা হতে বলার সময় সকলেই যে হিসাবটি করছেন, তা হল, একটি সন্তান যাবে সীমান্ত রক্ষায়, একটি বিশ্ব হিন্দু পরিষদে, একটি সাধুদের কাছে, একটি প্রযুক্তিবিদ বা ডাক্তার, ইত্যাদি। কেবল শংকরাচার্যই জননী-পিছু চারটি সন্তান নিজের জন্য ধার্য করেছেন। সম্ভাব্যতার অঙ্ক সরিয়ে রেখে এই সন্তানরা সকলেই পুত্র হবে, এটা এক রকম ধরেই নেওয়া হয়েছে। (না কি, কন্যাভ্রূণের সুপরিকল্পিত বিনাশের মাধ্যমে সেটা নিশ্চিত করে নেওয়া হবে?) তা ছাড়া, মনুস্মৃতি (যা এঁদের কাছে বেদস্বরূপ) তো পুরুষের অনন্ত নরকবাস ঠেকাতে প্রতিটি হিন্দু নারীকে পুত্রসন্তানই উপহার দিতে নির্দেশ করেছে। ধাঁধাটা হল, এঁদের কথা মানলে যে বিপুলসংখ্যক হিন্দু পুরুষ জন্মাবে, বড় হয়ে তারা কন্যে পাবে কোথায়?
ঠাট্টা থাক। হিন্দু পিতৃতন্ত্রের যে নির্লজ্জ আধিপত্যকামিতা এই নির্দেশে পরিস্ফুট, প্রশ্ন তোলা দরকার তা নিয়েও। নারীর শরীরের উপর, তাঁর নিজস্ব গর্ভের উপর এক্তিয়ার কার? তাঁর নিজের, না কি হিন্দুরাষ্ট্রবাদীদের? নারী তাঁর শরীর নিয়ে কী করবেন, তাঁর সন্তান-প্রজননের হার কী হবে, কখন তিনি গর্ভধারণ করবেন, কত বার গর্ভধারণ করবেন, একাধিক বার হলে তাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কতটা হবে, এ সব স্থির করার অধিকার সাক্ষী মহারাজ বা শংকরাচার্যকে কে কবে দিল? হিন্দুত্ববাদীদের বলি, মাতৃগর্ভ নিয়ে এই ন্যক্কারজনক রাজনীতি পরিহার করুন। নারীর শরীরকে নিজেদের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক ধান্দাবাজির কাজে ব্যবহার করার অন্যায় অনৈতিকতা থেকে নিরস্ত হোন।
আর, মুসলিম জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে ভাববেন না। শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে তাল রেখে মুসলিম মহিলারা নিজেরাই জন্মনিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসবেন। ইতিমধ্যেই সেই অগ্রগতির চেহারা গ্রামদেশে মিলতে শুরু করেছে। স্বামীর অনুমতি নিয়েই, কখনও বা এমনকী স্বামীকে লুকিয়েও মুসলিম ঘরের বধূরা উপর্যুপরি প্রজননের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভিড় জমাচ্ছেন। রাষ্ট্র বরং দেখুক, এই সব স্বাস্থ্যকেন্দ্র যাতে সংখ্যায় প্রসারিত হয়, গুণমানে উন্নত হয়।