সম্পাদকীয় ১

জবাবের প্রতীক্ষায়

চিনা কূটনীতিতে সংকেতের মাহাত্ম্য অপরিসীম। নরেন্দ্র মোদীর তাহা না জানিবার কারণ নাই। অতএব জাপানের মাটিতে দাঁড়াইয়া তিনি যখন চিনকে নামোল্লেখ না করিয়া ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর সম্প্রসারণবাদ’ হইতে নিবৃত্ত থাকিতে বলেন, তখন সেই উক্তিকে আকস্মিক বা হঠকারী বলিয়া মনে করিবার কোনও কারণ নাই। কথাটি বলিবার জন্য তিনি জাপানের মঞ্চকে সচেতন ভাবেই বাছিয়া লইয়াছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

চিনা কূটনীতিতে সংকেতের মাহাত্ম্য অপরিসীম। নরেন্দ্র মোদীর তাহা না জানিবার কারণ নাই। অতএব জাপানের মাটিতে দাঁড়াইয়া তিনি যখন চিনকে নামোল্লেখ না করিয়া ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর সম্প্রসারণবাদ’ হইতে নিবৃত্ত থাকিতে বলেন, তখন সেই উক্তিকে আকস্মিক বা হঠকারী বলিয়া মনে করিবার কোনও কারণ নাই। কথাটি বলিবার জন্য তিনি জাপানের মঞ্চকে সচেতন ভাবেই বাছিয়া লইয়াছেন। ইহাও লক্ষণীয় যে, অল্প দিনের মধ্যেই ভারত সফরে আসিতেছেন চিনের প্রধানমন্ত্রী, সেই সফরের পূর্বলগ্নে মোদীর এই সদুপদেশ। স্থান, কাল এবং পাত্র কূটনীতিতে তিনের সমাহার মূল্যবান। চিন-ভারত কূটনীতির পরিসরে ভারতকে সচরাচর রক্ষণাত্মক খেলা খেলিতেই দেখা যায়, সামনে পা বাড়াইয়া ব্যাট চালাইবার দৃষ্টান্ত সুলভ নহে। নেহরু-মেননের ‘ফরওয়ার্ড পলিসি’ স্মরণ করিয়া লাভ নাই, তাহা ভারতীয় কূটনীতির শৈশবের কাহিনি, শিশুসুলভ আচরণের কাহিনিও বটে। বাজপেয়ী জমানায় চিন সম্পর্কে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের ‘এক নম্বর শত্রু’ অভিধার কাহিনিও অপরিণত আচরণের নমুনা হিসাবেই ইতিহাসের পাদটীকায় স্থান পাইয়াছে। নরেন্দ্র মোদী সে পথের পথিক নহেন, তিনি বুঝিয়া শুনিয়াই পা বাড়াইয়াছেন এবং খেলিয়াছেন। তাঁহার সতর্কবাণীর মর্ম অতি স্পষ্ট বেজিংয়ের আগ্রাসী প্রবণতার সমালোচনায় মোদীর ভারত পিছপা হইবে না এবং সেই প্রবণতার বিরুদ্ধে জাপান-সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যে বিরাগ সম্প্রতি বাড়িয়াছে, ভারত তাহার সহিত কণ্ঠ মিলাইতেও দ্বিধাবোধ করিবে না। এশিয়ার কূটনৈতিক পরিসরে যে বিবর্তন ঘটিতেছে, ভারত তাহা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন এবং সেই বিবর্তনের প্রেক্ষিতে আপন স্থানাঙ্ক নির্দিষ্ট করিতে তৎপর।

Advertisement

এশিয়া তথা বৃহত্তর দুনিয়ায় ভারত ও চিন বিভিন্ন অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বী। অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক, দুই ধরনের ক্ষমতার দাবিদার হিসাবেই সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে এবং থাকিবে। অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তির বিচারে চিন অবশ্যই ভারত অপেক্ষা বিস্তর অগ্রবর্তী। কূটনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি সেই শক্তির উপর বিশেষ ভাবে নির্ভর করে, দুর্বল রাষ্ট্রকে কেহ আন্তর্জাতিক ক্ষমতার পরিসরে গুরুত্ব দেয় না, ভারত এক কালে তাহা ঠেকিয়া শিখিয়াছে। কিন্তু অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তির বিচারে আগে চিনের সমকক্ষ হইব, তাহার পরে আপন কূটনৈতিক গুরুত্ব দাবি করিব— বিদেশ নীতি এ ভাবে চলে না। বিদেশ নীতিতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে স্বার্থভিত্তিক সমন্বয়ের অবকাশ থাকে, সেই সমন্বয়কে কাজে লাগাইয়া প্রবলতর প্রতিপক্ষের কূটনৈতিক মোকাবিলা করা যায়, করিতে হয়। চিন সাম্প্রতিক কালে পূর্ব চিন সাগর সহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভাবে আপন অধিকার এবং আধিপত্য জাহির করিতে প্রবৃত্ত, তাহার ফলে জাপান হইতে ভিয়েতনাম, বিভিন্ন প্রতিবেশী শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ। এই পরিস্থিতি ভারতের সামনে নূতন কূটনৈতিক সুযোগ আনিয়া দিয়াছে। জাপানের সহিত সংযোগকে নূতন স্তরে উন্নীত করিবার যে উদ্যোগ মোদীর সফরে দেখা গেল, তাহা কেবল ভারতের উন্নয়নের পক্ষে সুবিধাজনক নহে, এশিয়ার কূটনৈতিক পরিসরে তাহার শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধির পক্ষেও অনুকূল। চিনের সহিত দর কষাকষিতে ইহা বিশেষ কাজে লাগিবে। বেজিং তাহা বিলক্ষণ জানে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রবল ভাষণের কোনও উচ্চকিত প্রতিক্রিয়া না জানাইয়া চিনের নায়করা আবারও বুঝাইয়া দিয়াছেন, বাস্তববাদী কূটনীতিতে তাঁহারা স্বভাবসিদ্ধ। কিন্তু সেই কারণেই কূটনৈতিক প্রত্যাঘাতের জন্য প্রস্তুত থাকাও দিল্লির নীতিকারদের কর্তব্য। মোদী অতঃপর তাঁহার খেলাটি যথেষ্ট দক্ষ ভাবে খেলিতে পারেন কি না, তাহা ক্রমশ প্রকাশ্য। আপাতত চিনা প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রতীক্ষা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement