সম্পাদকীয় ১

জয়তু দক্ষিণরায়

বঙ্গীয় পাদুকাপুরাণের সমাজে পরিকল্পনা ও উন্নয়নমন্ত্রী রচপাল সিংহ অহেতুক দোষের ভাগী হইতেছেন। রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র নবান্নে এক নিরাপত্তারক্ষী মন্ত্রিমহোদয়কে প্রকাশ্যে জুতা পরাইয়া দিয়াছেন, তুচ্ছ ঘটনা! শ্রীরামচন্দ্রের পাদুকা লইয়া ভরতের রাজ্যশাসনকে সংস্কৃত ভাষার আদিকবি ভ্রাতৃভক্তির বেশি কিছু ভাবেন নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৫ ০০:১৫
Share:

বঙ্গীয় পাদুকাপুরাণের সমাজে পরিকল্পনা ও উন্নয়নমন্ত্রী রচপাল সিংহ অহেতুক দোষের ভাগী হইতেছেন। রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র নবান্নে এক নিরাপত্তারক্ষী মন্ত্রিমহোদয়কে প্রকাশ্যে জুতা পরাইয়া দিয়াছেন, তুচ্ছ ঘটনা! শ্রীরামচন্দ্রের পাদুকা লইয়া ভরতের রাজ্যশাসনকে সংস্কৃত ভাষার আদিকবি ভ্রাতৃভক্তির বেশি কিছু ভাবেন নাই। কিন্তু ফুলিয়ার কবি অন্য তাৎপর্য দেখিয়াছিলেন, ‘তোমার পাদুকা রাম যদি থাকে ঘরে। ত্রিভুবনে ভরত কাহারে নাহি ডরে।।’ পাদুকাস্পর্শেই বাঙালি হৃদয়ে সাহস সঞ্চারিত হয়। উনিশ শতকের প্রচলিত উপকথা, চেয়ারে বসিয়াই বিদ্যাসাগর টেবিলের উপরে জুতা নাচাইয়া ব্রিটিশ সাহেবের মুখের উপর সমুচিত জবাব দিয়াছিলেন। বাঙালির জুতাদর্শন মধ্যযুগে ভয়ডরহীন ভ্রাতৃভক্তি, ঔপনিবেশিক যুগে নিঃসঙ্কোচ দেশভক্তি খুঁজিয়া পাইয়াছিল। এক্ষণে অটল প্রভুভক্তিও মিলিল।

Advertisement

রচপাল সিংহ একদা পুলিশকর্তা ছিলেন। তাঁহাকে দেহরক্ষীর জুতা পরাইয়া দিবার মধ্যে অনেকে আমলাতন্ত্রের ঔপনিবেশিক ভুক্তাবশেষ খুঁজিয়া পাইতে পারেন। কিন্তু শুধু উপনিবেশের ঘাড়ে দোষ চাপাইয়া রেহাই মিলিবে না। ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডে লর্ডদের কোট খুলিয়া যথাস্থানে রাখিবার ভৃত্য থাকিত, জুতা পরাইবার নহে। অমুক জুতা পরাইবে, তমুক পাঙ্খাবরদার হইয়া পাখা টানিবে ও সে হুঁকাবরদার হইয়া কলিকা সাজিয়া আনিবে, হারেমে একাধিক বিবি থাকিবে, এই সকল দুষ্ট কেতা ভারতীয় থাকবন্দি সমাজের সহিত কিছু অর্ধশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ বণিকের আদানপ্রদানের ফসল। কলিকাতায় বিনা আয়াসে এতগুলি ভৃত্য পাওয়া যায় বলিয়া অষ্টাদশ শতকেও মেমসাহেবরা লন্ডনে আহ্লাদিত চিঠি পাঠাইতেন। অপরপক্ষে বাঙালি ভাবিত, চাকুরিদাতা সাহেব দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, অন্নদাতা পিতার সমান। এবং, ‘আমি মূর্খ ও লম্পট বটে, কিন্তু তোমার খুল্লতাতের জেঠাশ্বশুর, ফলে বিজয়া দশমীর দিন আমাকে প্রণাম করা তোমার পবিত্র কর্তব্য’— প্রণিপাতের এই সামাজিক সংস্কৃতিতে জারিত বাঙালি জানে, গুরুজনের চরণস্পর্শই বিধেয়। দেহরক্ষী তো নিছক উপরওয়ালাকে জুতা পরান নাই, পিতৃসেবা করিতেছিলেন।

অনেকে এই ঘটনায় হিন্দি বলয়ের রাজনীতির প্রভাব দেখিতেছেন, জরুরি অবস্থার সময় বিমান হইতে সঞ্জয় গাঁধীর অবতরণকালে এক মন্ত্রীর পৃষ্ঠদেশ পাতিয়া দেওয়া তাঁহাদের মনে ঝিলিক দিতেছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এক রাজনীতিকের তাঁহার নেতার কাছে বিবেকবোধহীন নিঃশব্দ আত্মসমর্পণ ছিল, বেতনভুক দেহরক্ষীর কর্তব্য সমাপন ছিল না। হিন্দি বলয়ে কোনও দেবমূর্তির পায়ে জুতা থাকে না। বাংলার বাঘের দেবতা দক্ষিণরায় কিন্তু বরাবর জুতা পরিহিত। প্রভুর জুতাকেই থাকবন্দি বাঙালি সমাজ সর্বাধিক প্রণাম জানাইয়াছে। আজও তাই কোথাও অধ্যক্ষের উপস্থিতিতে অধ্যাপক উঠিয়া না দাঁড়াইলে তাঁহাকে কারণ দর্শাইতে হয়। পোস্টারে মুখ্যমন্ত্রীর সমান আকারে কারও মুখ আঁকা হইলে তাহা তৎক্ষণাৎ বাতিল জঞ্জাল। তুমি আইন ভাঙিয়াছ, কিন্তু মেয়রের ভ্রাতুষ্পুত্রী? বোমা ছুড়িয়া, থানা আক্রমণ করিয়াছ কিন্তু দলের লোক? তাহা হইলে নব্য ব্রাহ্মণ, তোমাদিগের সাত খুন মাফ। রচপালের দেহরক্ষীই এক এবং একমাত্র নন, বঙ্গীয় সমাজে জুতাবাহকের সংখ্যা ক্রমে বাড়িতেছে। কেহ গণতন্ত্রের কথা তুলিতে পারেন। যে তন্ত্রে সকলেই সমান, কেহ কাহারও গোলাম নহে। কিন্তু শরৎচন্দ্রের পাঠকমাত্রেই জানেন, এ জাতীয় কথা বলার পরে পল্লিসমাজে গফুরদের কী অবস্থা ঘটে! বাঙালি গণতন্ত্র, সাম্য কিছুই অভ্যাস করে নাই, শুধু উপগ্রহের ন্যায় ক্ষমতার কক্ষপথে ঘুরিয়াছে। ফলে সদর দফতরে কামান দাগা নয়, পাদুকাপুরাণেই তাহার ভবিতব্য।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন