তি ন সপ্তাহের মাথায় বামপন্থীরা প্রত্যাঘাত করিলেন। ডিমানিটাইজেশনের বিরুদ্ধে বন্ধ। যাঁহারা ভাবিতেছিলেন, হাজার টাকার নোটের ন্যায় বামপন্থীরাও বুঝি বাজার হইতে সম্পূর্ণ উধাও হইয়া গিয়াছেন, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট তাঁহাদের জানাইয়া দিল, তাঁহারা বদলান নাই। সীতারাম ইয়েচুরি মাঝেমধ্যে টুইট করেন বটে, কিন্তু তাহাই দলের একমাত্র অস্ত্র নহে। তাঁহাদের বন্ধ আছে। বস্তুত, তাঁহাদের শুধু বন্ধই আছে, রাজনীতি নাই। যে ‘সর্বহারা’-র নামে তাঁহারা ভুবন কাঁপাইয়া স্লোগান দেন, মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে ছোড়েন, নোট বাতিলের ধাক্কায় তাহাদের কতখানি ক্ষতি হইল, সেই আঁক কষিতেই তিন সপ্তাহ কাটিয়া গেল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরীবাল তো বটেই, এমনকী রাহুল গাঁধীও তাঁহাদের রাজনীতির জমি অধিগ্রহণ করিয়া ফেলিলেন দেখিয়াও শীতঘুম ভাঙিতে এতখানি সময় লাগিল। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আজ আর তাঁহাদের সাইনবোর্ডটিও কেন নাই, এ কে গোপালন ভবনের নেতারা তাহা বুঝাইয়া দিতে কসুর করেন নাই। আজ তাঁহাদের ডাকে জনজীবনে যতখানিই ব্যাঘাত ঘটুক না কেন, সন্ধ্যায় ‘ধর্মঘট সর্বাত্মক সফল’ বলিয়া আত্মপ্রসাদের হাসি হাসিয়া তাঁহারা ফের ঘুমাইয়া প়ড়িবেন। রাজ্যপাটই যখন নাই, তখন রাজনীতিতে সময় নষ্ট করে কোন আহাম্মক?
ভাবিবার অভ্যাস বামপন্থীদের কখনও বিশেষ ছিল না। তাঁহারা মানুষের কথা বুঝিতেন না, তাঁহারা ‘মানুষকে বুঝাইতেন’। অতএব, আজও তাঁহারা ভাবিবেন না, ডিমানিটাইজেশনের ন্যায় একটি অপ্রয়োজনীয় ও বহুলার্থে জনবিরোধী সিদ্ধান্তও কেন সাধারণ মানুষকে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ করে নাই। তাঁহারা বুঝিতে চেষ্টা করিবেন না যে ইহাই ভোগবাদের অভিজ্ঞান— তাহা মানুষকে রাজনীতি হইতে ক্রমে দূরবর্তী করে। সেই ভোগবাদের প্রতিস্পর্ধী ভাষ্য তৈরি করিবার দায়িত্ব বামপন্থীদেরই ছিল। তাঁহারা সম্ভবত সেই দায়িত্বের কথা উপলব্ধিই করেন নাই। সেই ফাঁক গলিয়া অ-রাজনীতি আসিয়া সমাজের দখল লইয়াছে। মাত্র কয়েক বৎসর পূর্বেও প্রকাশ্যে হিন্দুত্ববাদ জাহির করিবার মধ্যে একটি সামাজিক লজ্জার বোধ ছিল। লজ্জা গিয়া গৌরব আসিয়াছে। ইহা বামপন্থী রাজনীতির তুমুল ব্যর্থতা। এখন ভারত দেশপ্রেমের জোয়ারে হাবুডুবু খাইতেছে। দেশ বলিতে যে শুধু কাঁটাতারের সীমান্ত বোঝায় না, দেশ বলিতে যে শুধু কোনও একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত শত্রুতা বোঝায় না, দেশ মানে তাহার মানুষ, একশত ত্রিশ কোটি মানুষ— এই কথাটি বলিবার দায়িত্ব ছিল বামপন্থীদের। তাঁহারা ছিলেন মগন ঘুমের ঘোরে। এখন বন্ধ ডাকিয়া কর্তব্য সারিতেছেন।
তাঁহাদের বন্ধের ডাককে কেহ যেন ‘জনবিরোধী’ না বলে, তাহা নিশ্চিত করিতে বিমান বসুরা ব্যাঙ্ক ও এটিএমগুলিকে ছাড় দিয়াছেন। ডিমানিটাইজেশন কেন বিরোধযোগ্য, দৃশ্যতই বিমানবাবুরা তাহা বোঝেন নাই। তাঁহাদের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ থাকুক, হাতে যথেষ্ট নগদ না থাকা সমস্যাটির প্রথম ধাপ মাত্র। নগদের অভাবে অসংগঠিত ক্ষেত্র বসিয়া পড়িয়াছে, সংগঠিত ক্ষেত্রেও কাঁপুনি ধরিয়াছে। তাহাতে সর্বাধিক সমস্যা গরিব মানুষের, যাঁহাদের প্রতি দিনের বাজার খরচ প্রতি দিন উপার্জন করিতে হয়। ডিমানিটাইজেশন তাঁহাদের রুজি কাড়িয়া লইয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কঠোর অবস্থানে, আঁচ করা চলে, আজ ধর্মঘটের বিশেষ কোনও প্রভাব জনজীবনে পড়িবে না। কিন্তু, বিমানবাবুরা তো সফল ধর্মঘটের আশাতেই ডাক দিয়াছেন। অর্থাৎ, যে সিদ্ধান্ত মানুষের রুজি মারিতেছে বলিয়া তাঁহারা ক্ষুব্ধ, তাহার বিরোধিতা করিতে তাঁহারা সেই মানুষের রুজিরই ক্ষতি করিতে উদ্যত। স্ববিরোধ? না, ইহা রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা।