সম্পাদকীয় ১

টালিগঞ্জ অগ্রগামী

বঙ্গেশ্বরী এখন যে প্রকার নাজেহাল, তাহাতে শিল্পের ন্যায় অকিঞ্চিৎকর প্রসঙ্গ তাঁহার চিন্তায় নাই বলিয়াই অনুমান। বাণিজ্য মেলা বৎসরকার জিনিস, তাহাতে ফাঁক পড়িতে দেন নাই। কিন্তু, সেই সম্মেলনের যবনিকা পতনের পরও তিনি রাজ্যে বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ লইয়া ভাবিতেছেন, এতখানি বিশ্বাস করা কঠিন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share:

বঙ্গেশ্বরী এখন যে প্রকার নাজেহাল, তাহাতে শিল্পের ন্যায় অকিঞ্চিৎকর প্রসঙ্গ তাঁহার চিন্তায় নাই বলিয়াই অনুমান। বাণিজ্য মেলা বৎসরকার জিনিস, তাহাতে ফাঁক পড়িতে দেন নাই। কিন্তু, সেই সম্মেলনের যবনিকা পতনের পরও তিনি রাজ্যে বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ লইয়া ভাবিতেছেন, এতখানি বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁহার সময় নাই বলিয়া অবশ্য কিছু থামিয়া থাকে নাই। ভাইব্র্যান্ট গুজরাত সম্মেলনে মার্কিন বিদেশসচিব হইতে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রধান, রাষ্ট্রপুঞ্জের মহানির্দেশক, সকলেই উপস্থিত থাকিলেন। দেশ-বিদেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা বিনিয়োগ প্রস্তাবের ঝাঁপি লইয়া গেলেন। প্রস্তাবিত বিনিয়োগের অঙ্ক পঁচিশ লক্ষ কোটি টাকা। গুজরাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগের প্রস্তাব আসে, বাস্তবায়িত হয় তাহার অংশমাত্র এমন অভিযোগ বেশ প্রচলিত। কথাটি যদিও সব বিনিয়োগ সম্মেলনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে, গুজরাতের অঙ্কটি পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সাড়ে দশ গুণ। এবং, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী-ঘোষিত মোট বিনিয়োগ প্রস্তাবের অঙ্কটি যেমন রহস্য-রোমাঞ্চে মোড়া, গুজরাতের ক্ষেত্রে তেমন কোনও অস্বচ্ছতার প্রয়োজন পড়ে নাই। বিনিয়োগ টানিবার খেলায় কোন রাজ্য জিতিল, প্রশ্নটি অবান্তর। এফসি বার্সেলোনা আর টালিগঞ্জ অগ্রগামীর মধ্যে খেলা হয় না।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গ কেন এই অন্ধকারের অতলে পৌঁছাইল, সেই কারণটি বহু-আলোচিত। রাজ্যটি কেন এখানেই থাকিবে, তাহার আরও একটি কারণ পাওয়া গেল। ভারতীয় অর্থনীতি যে পথে হাঁটিতেছে, তাহাকে ‘প্রতিযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা’ বলা চলে। অর্থাৎ, দেশের বিভিন্ন রাজ্য বিনিয়োগ টানিবার জন্য পরস্পরের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবে। যে রাজ্য পারিবে, সেখানে বিনিয়োগ আসিবে, রাজ্যের উন্নতি হইবে। আর যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জমি না ছাড়িবার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি না করিবার জেদ ধরিয়া থাকিবেন, সেই রাজ্যে বড় জোর স্থানীয় শিল্পপতিদের লইয়া নদীবক্ষে সারারাত্রব্যাপী বিচিত্রানুষ্ঠান হইবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি কথাটি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁহার (ভাবাদর্শগত) পূর্বসূরি বামপন্থীরা এই নূতন খেলাটি ধরিতেই সমস্যায় পড়িতেছেন। রাজ্য শিল্পে মার খাইলে তাঁহারা এত দিন ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’র বাঁধা বুলি আউড়াইয়া পাশ ফিরিয়া শুইতেন। কেন্দ্রীয় সরকারই যখন রাজ্যগুলির শিল্পায়নের প্রশ্নটিকে মূলত বাজারের হাতে ছাড়িয়া দিয়াছে, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা কী করিবেন? বিনিয়োগের মেলা করিলেই যে দায়িত্ব ফুরাইয়া যায় না, শিল্পমহলের মনে বিশ্বাস তৈরি না করিতে পারিলে কেহ যে পশ্চিমবঙ্গের দিকে ফিরিয়াও তাকাইবেন না, এই কথাগুলি বঙ্গেশ্বরী আর কবে বুঝিবেন? এখন তো আবার তিনি হাজার ঝামেলায়। ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটার ফাঁকে সেই সব দায়িত্বের কথা তাঁহার স্মরণে আসিবে কি?

ভাবিবার সময় পাইলে মুখ্যমন্ত্রী দেখিবেন, অরুণ জেটলি তাঁহার জন্য এক সুবর্ণসুযোগের কথা ঘোষণা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গ যদি ঘুরিয়া দাঁড়াইতে চাহে, কেন্দ্রীয় সরকার সর্ব প্রকার সহযোগিতা করিবে। রাজস্বের হিস্যা বৃদ্ধি হইতে রাজ্যের পরিকাঠামো নির্মাণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাহায্যের আশ্বাস মিলিয়াছে। সেই আশ্বাস হইতে রাজনীতির জলটুকু ছাঁটিয়া ফেলিলেও অনেকখানিই পড়িয়া থাকিবে। চাহিলে, তিনি আরও দাবিদাওয়া পেশ করিতেও পারেন। কিন্তু, ইহা আংশিক সমাধান। শুধু পরিকাঠামো নাই বলিয়াই এই রাজ্যে শিল্প আসে না, অনুব্রত মণ্ডলরাও সম্ভবত এমন কাঁচা কথা বলিবেন না। এই রাজ্যের বাকি সমস্যাগুলির সমাধান করিতে বঙ্গেশ্বরীর সদিচ্ছা ব্যতীত পথ নাই। জমি নীতিই হউক অথবা শিল্পক্ষেত্রে দলীয় তাণ্ডব নিয়ন্ত্রণ, অথবা রাজ্যে আইনের শাসন ফিরাইয়া আনা, সবই বঙ্গেশ্বরীর মুখ চাহিয়া আছে। এবং সেই কারণেই, কাজগুলি বকেয়াই পড়িয়া থাকিবে বলিয়া আশঙ্কা। এই কাজে তো ভোট হয় না। যেখানে ভোট নাই, সে দিকে নজর করিবার কু-অভ্যাসও মুখ্যমন্ত্রীর নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement