তেত্রিশ বছর একটানা হোয়াইট হাউসের সামনে

বয়স ৭৭। ওয়াশিংটন ডিসি’তে হোয়াইট হাউসের সামনে তাঁবু খাটিয়ে বাস করেন তিনি। পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিবাদে। পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়হোয়াইট হাউসের ঠিক উল্টো দিকে লাফায়েত পার্কঘেঁষা ফুটপাথে কোনি-র সঙ্গে দেখা। জন্মসূত্রে স্পেনীয়, উচ্চতা মেরেকেটে ৫ ফুট, কুঁজো হয়ে গিয়েছেন বলে আরও কম মনে হয়। সাতাত্তর বছরের ফোকলা হাসিখুশি মুখে কাটাগোল্লা খেলার ঘরের মতো আঁকিবুকি। চোখ দু’টো আশ্চর্য উজ্জ্বল। টানা তেত্রিশ বছর প্রতিটি ঋতু কনসেপসিয়োন পিস্সিয়োত্তো ওরফে কোনি বিশ্বের এই সবচেয়ে শক্তিশালী সাদাবাড়ির মুখোমুখি একটা কাঠের টুলে বসে রয়েছেন!

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৪ ০০:১৫
Share:

হোয়াইট হাউসের ঠিক উল্টো দিকে লাফায়েত পার্কঘেঁষা ফুটপাথে কোনি-র সঙ্গে দেখা। জন্মসূত্রে স্পেনীয়, উচ্চতা মেরেকেটে ৫ ফুট, কুঁজো হয়ে গিয়েছেন বলে আরও কম মনে হয়। সাতাত্তর বছরের ফোকলা হাসিখুশি মুখে কাটাগোল্লা খেলার ঘরের মতো আঁকিবুকি। চোখ দু’টো আশ্চর্য উজ্জ্বল। টানা তেত্রিশ বছর প্রতিটি ঋতু কনসেপসিয়োন পিস্সিয়োত্তো ওরফে কোনি বিশ্বের এই সবচেয়ে শক্তিশালী সাদাবাড়ির মুখোমুখি একটা কাঠের টুলে বসে রয়েছেন! এটাই তাঁর আন্দোলন। পরমাণু যুদ্ধ, পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে, খোদ আমেরিকার পরমাণু নীতির বিরুদ্ধে। হম্বিতম্বি নেই, চিৎকার নেই। সংযত, অবিচল থেকে শাসককে লাগাতার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া: ‘তুমি ভুল করেছ, তোমার যা করার ছিল করোনি।’ পাঁচ-পাঁচ জন প্রেসিডেন্টের সময়সীমা পার করেও খর্বদেহী বৃদ্ধাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি মার্কিন সরকার।

Advertisement

শৈশবে বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন কোনি। বড় করেন দিদিমা। ১৮ বছরে স্পেন থেকে নিউইয়র্কে এসে স্পেনীয় দূতাবাসে চাকরি। ২১ বছর বয়সে ইতালীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে। মেয়ের মা হন ১৯৭৩ সালে। তার পরই ডিভোর্স, মেয়ের অধিকার নিয়ে দীর্ঘ লড়াই। হেরে যান কোনি। ঠিক করেন, নিজের অধিকারের বদলে এ বার অনেকের অধিকার নিয়ে লড়াই করবেন, প্রশ্ন তুলবেন, জবাব চাইবেন। ১৯৮১ সালে ৪৩ বছর বয়সে তল্পিতল্পা নিয়ে চলে আসেন হোয়াইট হাউসের সামনে। সেখানে তখন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছেন উইলিয়াম টমাস হ্যালেনব্যাক নামে এক মার্কিন। কোনি তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। তার পর আর ওঠেননি। কখনও পুলিশ তাঁদের জেলে ভরেছে, পিঠে লাঠির বাড়ি পড়েছে, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, দুষ্কৃতীরা অস্থায়ী তাঁবু ভাঙচুর করেছে, রাতের অন্ধকারে গায়ের উপর গাড়ির চাকা তুলে দিয়েছে কিন্তু কোনিদের দমানো যায়নি। ২০০৯-এ হ্যালেনবাকের মৃত্যুর পরে কোনি একাই। পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী ছোট-ছোট ব্যানার-পোস্টার-লিফলেট নিয়ে বসে থাকেন তাঁর ছোট্ট তাঁবুর বাইরে। ভালবেসে যখন যে-যা খেতে দেন খান, যা পরতে দেন পরেন। রোজ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক হোয়াইট হাউস দেখতে আসেন। কোনি আলাপ জমান, লিফলেট বিলি করেন, কেউ আর একটু আগ্রহী হলে তাঁকে অল্প কথায় পারমাণবিক অস্ত্র আর যুদ্ধের ক্ষতি বোঝানোর চেষ্টা করেন।

ফল? ১৯৯৩ সালে টমাস আর কোনির আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি ইলিয়ানর হোমস নর্টন পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন। কংগ্রেসে একাধিক বার প্রসঙ্গটি উঠেছিল, কোনও বারই আলোচনা হয়নি। তা হলে এই প্রতিবাদে লাভ কী? লাভ নয়, প্রতিবাদটাই প্রকৃত প্রতিবাদীর ধর্ম।

Advertisement

কোনির সঙ্গে দেখা হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ। ভারতীয় সাংবাদিক দেখে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, তাঁর এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণা আসলে মহাত্মা গাঁধী। ভারতে তিনি কখনও আসেননি, মহাত্মাকেও দেখেননি, শুধু তাঁর বই পড়েছেন। গাঁধী এবং ভারত সম্পর্কে যখন যেখানে যা লেখাপত্র পান, পড়ে ফেলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন। আক্ষেপ জানালেন, গাঁধীর দেশের আমজনতা এখনও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার বাইরে শুধু নাগরিকের পরিচয়ে জনপ্রতিনিধিদের মুখের উপর জবাবদিহি চাইতে পারে না। বলতে পারে না, ‘‘আপনার এটা-এটা করার কথা ছিল, আপনি করতে পারেননি। কেন পারেননি ব্যাখ্যা দিন।’’

ঠিকই তো। নির্বাচনী প্রচারের এই সদ্য-শেষ সময়টা এক বার ভেবে দেখুন। পাঁচ বছরে যে সব নেতাকে এলাকার ত্রিসীমানায় দেখতে পাননি তাঁরা ঝাঁকে ঝাঁকে আকর্ণ হাসি নিয়ে, জোড়হাতে আপনার দরজায়, উঠোনে, বাজারে, গলিতে সপারিষদ ঘুরে বেড়ালেন। এত দিনে যা-যা কাজ করবেন বলে শপথ নিয়েছিলেন তার সিকিও করেননি। আপনিও বিলক্ষণ জানেন, এ চরিত্র পাল্টাবার নয়, ক্ষমতায় এলে আগামী পাঁচ বছর আবার খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ তিনি দিব্যি আবার একই কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাচ্চাদের গাল টিপে, বয়স্কদের পা ছুঁয়ে, গলার শিরা ফুলিয়ে নির্লজ্জের মতো ভোট চাইলেন।

আমরা ক’জন তখন নেতার মুখের সামনে আয়নাটা ধরতে পারলাম? তাঁকে নাগালের মধ্যে পেয়েও ক’জন বলতে পারলাম, ‘আপনি কাজে ব্যর্থ, তাই এ বার কেন আপনার উপর আস্থা রাখব উত্তর দিন।’ উল্টে আমরা বেশির ভাগই হাত কচলে, বিগলিত হয়ে ঘাড় নাড়লাম। আমাদের দুর্ভাগ্যের জন্য আমরাই দায়ী।

অনেকে বলবেন, ইচ্ছা করলেই প্রতিবাদী হওয়া যায় না। তাতে সরাসরি চিহ্নিত হওয়ার ভয় থাকে। দলের লোকেরা তখন পাড়ায় টিঁকতে দেবে না। জীবন জেরবার করে দেবে। তখন কে বাঁচাবে? অবোধ শিশু রাজাকে মুখের উপর ‘উলঙ্গ’ বলতে পারে, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে সেটা মূর্খামি। অধিকার মাথায় থাক, নির্বিবাদী হয়ে এই বেশ ভাল আছি।

কোনিকে সে কথা বলতে মুচকি হেসে পরনের রঙচটা উইন্ডচিটারটা ঠিক করতে করতে বলেছিলেন, “সেই জন্যই বোধহয় প্রকৃত অ্যাক্টিভিস্টকে একটু আবেগপ্রবণ আর একটু খ্যাপাটে হতে হয়। মস্তিষ্কের হিসেব বাদ দিয়ে সে শুধু মনের কথা শুনে ঝাঁপাবে। কারও পরোয়া না-করে অতি শক্তিমানকেও আঙুল দিয়ে একটা একটা করে ভুল দেখিয়ে দিতে পারবে।” হয়তো এই কাজে সে বেশি লোকের সাহায্য পাবে না। কারণ সাধারণত মানুষ এঁদের বুঝতে পারে না, অস্বস্তি বোধ করে বা সন্দেহের চোখে দেখে। সে সব নিয়ে না ভেবে দীর্ঘ একটা সময় ধরে নিজের দাবি জানিয়ে যেতে হবে, ভুলতে দিলে চলবে না।

আমাদের ১২৭ কোটির গণতন্ত্রে আবেগপ্রবণ, খ্যাপাটে কোনিদের অভাব বড় বেশি।

ছবি: লেখক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন