য তক্ষণ আমি মধু পান করিতেছি, তত ক্ষণই অপেক্ষা— তাহার পর তোদের বধ করিব।’ হুমকিটি প্রাচীন। তবে, পুরাতন মধু নূতন বোতলেও মিলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপাতত নির্বাচনের ফুলে ক্ষমতার মধু পান করিতে ব্যস্ত। তাহারই ফাঁকে তিনি হুমকি দিয়া রাখিয়াছেন, যে পুলিশকর্মীরা নির্বাচনে ‘কেন্দ্রীয় সন্ত্রাসে মদত দিলেন’— অর্থাৎ, বঙ্গেশ্বরীর আইন অমান্য করিয়া তৃণমূলের যথেচ্ছাচারকে প্রশ্রয় দিলেন না— ‘আগামী দিনে তাঁহাদের ভুগিতে হইবে’। ১৯ মে ক্ষমতায় ফিরিলে সব কিছুর উত্তর তিনি ইঞ্চিতে-ইঞ্চিতে বুঝিয়া লইবেন। দিদি যাহা ছিলেন এবং যাহা হইয়াছেন, তাহাতে বিস্তর ফারাক। কিন্তু, বিরোধী বা শাসক, কোনও অবতারেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি তাঁহার কোনও ভক্তি নাই, থাকিলেও তাহা তিনি যত্নে লুকাইয়া রাখেন। ২০১১ সালে নির্বাচন কমিশন সক্রিয় হইলে বা কেন্দ্রীয় বাহিনী আসিলে তাঁহার লাভ ছিল, ২০১৬ সালে, অন্তত তাঁহার নিজস্ব বিচারে, ক্ষতি। নির্বাচন কমিশনের প্রতি, বাহিনীর প্রতি, রাজ্য পুলিশের প্রতি, অথবা সংবাদমাধ্যমের প্রতি তাঁহার অবস্থান নির্ধারিত হয় এই ব্যক্তিগত, বা দলগত, লাভক্ষতির দাঁড়িপাল্লায়। তাঁহার ক্ষতির মূল্যে গণতন্ত্রের লাভ হইবে, একেশ্বর/রীদের পক্ষে তাহা মানিয়া লওয়া মুশকিলই নহে, অসম্ভব। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে যতখানি অসম্ভব, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেও ততখানিই।
অতএব, বঙ্গেশ্বরী যুদ্ধে নামিয়াছেন। সংবাদমাধ্যমের একাংশের বিরুদ্ধে তাঁহার ক্ষোভ, নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাঁহার অনাস্থা তিনি ভোটযুদ্ধের প্রথম দিন হইতেই ব্যক্ত করিয়া চলিতেছেন। শত্রুর তালিকায় পুলিশের নাম যোগ হওয়াটি তাৎপর্যপূর্ণ। সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বা রাজীব কুমাররা সাক্ষ্য দিবেন, নেত্রীর বিরাগভাজন হইবার ধৃষ্টতা গত পাঁচ বৎসরে পুলিশ বিশেষ করে নাই। কিন্তু, হয়তো নির্বাচন কমিশনের ধাতানিতেই, পুলিশের হুঁশ ফেরা ইস্তক নেত্রী ও তাঁহার পারিষদরা বেদম চটিয়াছেন। কেহ ‘জরুরি অবস্থা’র প্রসঙ্গ টানিয়া আনিতেছেন তো কেহ পুলিশকে ঘিরিয়া বিক্ষোভ দেখাইতে ব্যস্ত। সর্বাধিনায়িকা তো তত্ত্বই খা়ড়া করিয়া ফেলিয়াছেন যে, কেন্দ্রীয় বাহিনী বিজেপি-র হইয়া ভোট লুঠ করিতেছে। শাসক দলের এই পরিমাণ অস্বস্তিই বলিয়া দিতেছে, পুলিশ অবশেষে তাহার দায়িত্ব পালন করিয়াছে। স্বাভাবিক অবস্থায় কর্তব্য সম্পাদনের জন্য অভিনন্দন প্রাপ্য হয় না। কিন্তু, বঙ্গেশ্বরীর খাসতালুকে মেরুদণ্ড ফিরাইয়া আনা কম কথা নহে। সাধারণ মানুষ ফের পুলিশের প্রতি আস্থাবান হইতেছে, পুলিশের উর্দিকে অশ্রদ্ধেয় জ্ঞান করিতেছে না, ইহাই সম্ভবত বাহিনীর শ্রেষ্ঠ সম্মান।
পুলিশ রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে, ফলে তৃণমূলেশ্বরীর ইচ্ছা পূর্ণ হয় নাই। বিধাননগর পুরসভায় তিনি যাহা পারিয়াছিলেন, এই দফায় পারেন নাই। চেষ্টার অবশ্য খামতি ছিল না। এই চেষ্টাই প্রমাণ, তিনি তাঁহার সাংবিধানিক দায়িত্বটিকে কখনও গুরুত্বই দেন নাই। যতই নির্বাচন চলুক, তিনি যতই তাঁহার দলের সর্বেসর্বা হউন, তিনি এখনও এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। নির্বাচনে গণতন্ত্রের সম্মান যে ভূলুণ্ঠিত না হয়, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্বটি তাঁহার স্কন্ধেই ছিল। তাঁহার পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা অপেক্ষাকৃত সহজও ছিল, কারণ তাঁহার দলে তিনিই আদি, তিনিই অন্ত। তিনিই সংবিধান, তিনিই আইন। ফলে, তিনি চাহিলে দলও সংযত হইত। তিনি চাহেন নাই। রাজ্যের প্রধান প্রশাসক হিসাবে তাঁহার এই সার্বিক ব্যর্থতা অক্ষমণীয়। এবং, ক্ষমা না করিবার অধিকার রাজ্যের সাধারণ মানুষের হাতে। পশ্চিমবঙ্গকে সংবিধানরহিত জঙ্গলে পরিণত করিবার সাজা রাজ্যবাসীই তাঁহাকে দিতে পারেন। ভোটের যন্ত্রে।