কবি বৃথা স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। নবজাতকের প্রতি কোনও অঙ্গীকার পালনের ক্ষমতাই এই বিশ্বপৃথিবীর নাই। এমনকী তাহাদের বাঁচিবার ব্যবস্থাটুকু কিংবা নিঃশ্বাস লইবার অধিকারটিও বর্তমান প্রজন্মসমূহ নির্মম ভাবে ধ্বংস করিয়া যাইবে। কাহারও কিছু বলিবার নাই। অভিযোগটি তুলিয়াছে নবজাতকরাই। আদালতে সাক্ষাৎ মামলাও ঠুকিয়াছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে অভূতপূর্ব মামলাটি গত সপ্তাহে আসিয়া পৌঁছাইয়াছে। মামলাকারী তিন শিশু। বয়স ছয় মাস, ছয় মাস ও চৌদ্দো মাস! বিচারকদের সামনে তাহাদের প্রশ্ন: দিল্লির মারাত্মক বায়ুদূষণের ফলে তাহাদের ইতিমধ্যেই যে শারীরিক খেসারত দিতে হইতেছে, তাহার দায় কাহার? দায় যাহাদের, তাহারা কি শাস্তিযোগ্য নয়? যদি তাহারা শাস্তির যোগ্য হয়, কে তাহাদের শাস্তি দিবে? কেন সম্পূর্ণ অজ্ঞানে, অন্যদের করা অপরাধের ভার লক্ষ কোটি নিরপরাধ শিশুকে চিরজীবন শারীরিক ভাবে বহিতে হইবে? গত দুই বৎসরের মধ্যে দেশের রাজধানী পৃথিবীর সর্বাধিক দূষিত শহরে পরিণত হইয়াছে। হাওয়ার দূষণমাত্রা এখানে সর্বোচ্চ মাত্রায়। কেবল বাজি পুড়াইবার নামেই যে পরিমাণ বায়ুদূষণ ঘটে, তাহা মাথায় রাখিলে এখনই দীপাবলির মতো উৎসবে কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি করা জরুরি। ইউরোপীয়দের তুলনায় ভারতীয়দের ফুসফুসের ক্ষমতা ৩০ শতাংশ কমিয়াছে। সর্বাধিক ক্ষতি শিশুদের, যাহাদের ফুসফুস তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল।
যেখানে ইউরোপীয় শিশুদের ক্ষেত্রে, জন্ম-পরবর্তী দুর্বল ফুসফুস পরবর্তী কালে সুস্থ নির্বিষ বাতাসে লালিত হইয়া সক্ষম ও সবল হইয়া উঠে, ভারতীয় শিশুদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টাটিই ঘটে। তাহাদের ফুসফুস এই প্রারম্ভিক দুর্বলতা কাটাইবার পরিবেশ পায় না। কারণ ভারতীয় শিশুদের পরিবৃত করিয়া থাকে যে ভারতীয় সমাজ, তাহার গোটাটাই এই বায়ুদূষণ প্রকল্পের অতীব সক্রিয় অংশীদার। নিজেদের অন্যায়ের দায় অপরের উপর সঁপিয়া দিতে কোনও কালেই তাহার দ্বিধা নাই। এমনকী পর-প্রজন্মের উপর অন্যায় অনাচার চালাইতেও নয়। শিশুরা মামলা ঠুকিতেছে, ইহা অবশ্যই একটি আলঙ্কারিক বাক্য। প্রতীকীও বটে। তাহাদের অভিভাবকরা যে আদালতে তাহাদের নাম ব্যবহার করিয়াছেন,অনেকেই ইহাতে ‘নাট্যশালা’র গন্ধ পাইয়া মুখ বাঁকাইতেছেন। তবে নাটক বস্তুটিকেও একমাত্রায় দেখিবার অভ্যাসটি ভাল নয়। কিছু কিছু ভয়ঙ্কর সত্যকে সামনে আনিবার জন্য নাটক একটি জরুরি মাধ্যম বই কী।
বিশেষ করিয়া যখন বাস্তব পরিস্থিতির অবহেলা, উপেক্ষা, অনাচারের কোনও শেষ নাই, তখন বাস্তবের সাধারণ পদ্ধতিগুলি হইতে সরিয়া গিয়া অ-সাধারণ প্রকরণ খুঁজিয়া বাহির করিবার মধ্যে একটি প্রতিবাদ আছে। বিধ্বংসী সভ্যতার উন্নাসিক অহঙ্কারে ভাসিয়া না গিয়া সেই প্রতীকী প্রতিবাদকে কুর্নিশ জানানো দরকার। বিশেষত শিশুদের লইয়া যদি সেই প্রকরণ তৈরি হয়, তাহা হইলে কথাই নাই। ইহারাও নাগরিক। দস্তুরমতো অধিকারভোগী নাগরিক। কিন্তু ইহাদের এখনও বোধ-বিবেচনা হয় নাই। সেই অবকাশটুকুর সুযোগ লইয়া তাহাদের প্রতি অনাচার করিবার অধিকার আমাদের নাই, ইহা যদি শিশু-পর্নোগ্রাফি কিংবা শিশু-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুক্তি হয়, তবে এই একই যুক্তি দূষণের প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ প্রযোজ্য। সেই দিক দিয়া এই মামলাটি ভারতীয় বিচারবিভাগের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপনের দাবি রাখে।