সাক্ষাৎকার

দরকার একটা অখণ্ড ইউনিট তৈরি করা

বিশ্বভারতীর নানা বিভাগের মধ্যে, এমনকী স্কুল ও উচ্চশিক্ষার মধ্যেও সংযোগ চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই ভাবনাটাতেই ফিরতে চান বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত। সাক্ষাৎকার নিলেন অর্চিমিত্র।কিছু কাল আগে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আপনি দুটি বক্তৃতা দিয়েছেন। এই বক্তৃতা কি কেবল আনুষ্ঠানিক, নাকি বিশ্বভারতী সম্পর্কে আপনার নতুন কোনও বক্তব্য আছে? প্রথমেই বলি, বিশ্বভারতী নামের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় বলাটাই নিষ্প্রয়োজন। বিশ্ব এবং বিদ্যাচর্চার মূল ধারণাগুলি এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

কিছু কাল আগে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আপনি দুটি বক্তৃতা দিয়েছেন। এই বক্তৃতা কি কেবল আনুষ্ঠানিক, নাকি বিশ্বভারতী সম্পর্কে আপনার নতুন কোনও বক্তব্য আছে?

Advertisement

প্রথমেই বলি, বিশ্বভারতী নামের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় বলাটাই নিষ্প্রয়োজন। বিশ্ব এবং বিদ্যাচর্চার মূল ধারণাগুলি এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। বিশ্বভারতী তার নাম থেকেই ইউনিক, অনন্য। লক্ষ করবেন, যদিও বিশ্বভারতী পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথের আদর্শে তাঁরই নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান, তবু তাঁর ইচ্ছাতেই এর নামে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নেই। তাই এটি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বিশ্বভারতী। রাজনীতিবিদরা পরে কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িটাকে নিয়ে যা করেছেন তাতে তাঁর কোনও ভূমিকা ছিল না।

Advertisement

অন্যান্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় কোথায় আলাদা বিশ্বভারতী?

এর প্রত্যেকটি ভবন এবং তার সংলগ্ন বিভাগগুলির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী দূরদর্শিতা এবং অভূতপূর্ব সৃষ্টিশীলতা জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে তাঁর শিক্ষাদর্শন। কিন্তু তারও আগে, এর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যটা বোঝা উচিত। নালন্দা বা তক্ষশিলার কয়েক যুগ পরে ১৮৫৭ সালে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হল, মেকলের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় ঐতিহ্য ও কৃষ্টি বর্জন করে ‘বাবু’ তৈরি করা, যাতে প্রশাসনিক কাজকর্ম যথাযথ চালানো যায়। কিন্তু ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন কলকাতা থেকে অনেক দূরে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করলেন তখন তিনি শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ব্রিটিশ প্রভাবটা বর্জন করতে চান। লক্ষ্য ছিল, ভারতীয় শিক্ষাধারায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি।

অর্থাৎ সামূহিক শিক্ষা...

ঠিক তাই। মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা, সন্তোষ পাঠশালা, পাঠভবন, শিক্ষাসত্র বা বিশ্ববিদ্যালয়কে কোথাও আলাদা করতে চাননি রবীন্দ্রনাথ। চেয়েছিলেন এই ইস্কুল ও পাঠশালাগুলিকে বিশ্বভারতীর সঙ্গে জৈবিক বন্ধনে নিয়ে আসতে। আধুনিক শিক্ষাপ্রণালীতে বুনিয়াদি শিক্ষার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আর্টস, হিউম্যানিটিজ, সায়েন্স— এ রকম খোপ খোপ ভাগ করা নেই।

কিন্তু শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন-এর মধ্যে যেন একটা শ্রেণিবৈষম্য আরোপিত হয়ে গিয়েছে, যেন শান্তিনিকেতন উঁচু শ্রেণি, শ্রীনিকেতন কিঞ্চিৎ নিচু...

শান্তিনিকেতনের পাঠভবন ও শ্রীনিকেতনের শিক্ষাসত্রের মধ্যে একটা সংযোগসাধন করতে চাই আমি। যে উদ্ভাবনমূলক শিক্ষা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য, তাকে এই সংযোগ একটা বাস্তবতা দিতে পারে। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের মধ্যে যে একটা অলিখিত বৈষম্য কাজ করে, সেটা মুছে দেওয়া দরকার। একই ভাবে কলাভবন ও শিল্পসদনকে সংযুক্ত করলে আমরা একটা আধুনিক ইনস্টিটিউট অব ডিজাইন-এর কথা ভাবতে পারি। সংগীত, নৃত্য এবং নাটকের যে সমন্বয় তিনি ঘটাতে চান, তা গভীর গবেষণার দিক খুলে দিয়েছে আমাদের কাছে। এই অ্যাসিমিলেশনটা খানিকটা কেমিকাল রিঅ্যাকশনের মতো, যাতে রিঅ্যাকটিং এজেন্ট-দের আলাদা সত্তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রনৃত্য, রবীন্দ্রনাট্য বিশ্বভারতীরই বিশিষ্ট অবদান, এমন নিজস্ব অবদান পৃথিবীর আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই ত্রিবিদ্যাচর্চাকে আমরা যদি বাঁচিয়ে রাখতে না পারি, তবে বিশ্বভারতীর অস্তিত্বই সংকটময় হবে।

একটা অভিযোগ শোনা যায় যে, কবি, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বভারতী যত গুরুত্ব দেয়, কর্মী রবীন্দ্রনাথকে ততটা নয়...

রবীন্দ্রনাথের গ্রামীণ পুনর্গঠনের দিকটা খুব জরুরি, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষিবিদ্যা, পল্লিচর্চা, পল্লি সম্প্রসারণের কাজ। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী তৈরি হওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতন নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। ভারতে পরে অনেক কৃষিবিদ্যালয় হয়েছে। কল্যাণী, হিসার, হায়দরাবাদ কিন্তু এই ভাবনাটার সূত্রপাত বিশ্বভারতীতেই। বিনয় ভবনের সঙ্গে আমরা গ্রামীণ পুনর্গঠনের যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইছি। বটানি, জুলজি, ফিজিয়োলজি, বায়োটেকনোলজি-র মতো মৌলিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলিকে কৃষিবিজ্ঞানকে জুড়ে দিতে চাইছি।

হিমালয়ান স্টাডি-র জন্য একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা হচ্ছে। এখন এই নতুন বিষয়গুলি গুরুত্ব পাচ্ছে অথচ এশিয়ান স্টাডিজ-এর মতো একটি বিদ্যাচর্চার ভাবনার রূপায়ণ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চিন ভবন, নিপ্পন ভবন প্রতিষ্ঠার সময়ই করেছিলেন। কিন্তু সে ভাবনা কি এখন শুধু চিনচর্চা, জাপানচর্চায় ডিগ্রি নেওয়াতেই পর্যবসিত হয়ে যায়নি?

বর্তমান পৃথিবীর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পটভূমিকায় এবং এশীয় দেশগুলির, বিশেষ করে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির পরিপ্রেক্ষিতে চিন ও জাপানের গুরুত্ব নতুন করে বুঝতে হবে। আমার মতে, বিশ্বভারতীকে নতুন করে ভাবতে হবে কী করে চিন ভবন, নিপ্পন ভবনের কারিকুলামের সঙ্গে ভারত-তিব্বত চর্চা এবং বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চাকে যুক্ত করা যায়। এই চেষ্টার মধ্যে আমাদের দর্শন বিভাগেরও একটা বিশিষ্ট ভূমিকা থাকবে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়েও চিনা ও জাপানি ভাষা ভাল ভাবে পড়ানো হয়। বস্তুত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিনা ভাষার শিক্ষকদের বিশ্বভারতী থেকেই রফতানি করা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বভারতীকে মনে রাখতে হবে তার প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু কেবল ভাষাচর্চার জন্য ওই দুই ভবনের কথা ভাবেননি।

এই যে বিভিন্ন ভবনকে সংযুক্ত করার কথা আপনি বলছেন, তাতে আশ্রমের এতদিনকার ঐতিহ্য, পরম্পরা ক্ষুণ্ণ হবে না?

আশ্রম থেকে মাঝে মাঝে না বেরোতে পারলে বোধহয় রবীন্দ্রনাথের আধুনিক শিক্ষাভাবনার রূপায়ণ করা সম্ভব নয়। বেরনোর কথাটাও কিন্তু রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন। বিশ্বভারতী-র সংবিধান যখন তৈরি হল তখনকার একটি বক্তৃতায় বলছেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানের বাহ্যায়তনটিকে সুচিন্তিত বিধি-বিধান দ্বারা সুসম্বদ্ধ করবার ভার আপনারা নিয়েছেন, এই নিয়ম-সংঘটনের কাজ আমি যে সম্পূর্ণ বুঝি তা বলতে পারি নে, শরীরের দুর্বলতা-বশত সব সময়ে এতে আমি যথেষ্ট মন দিতেও অক্ষম হয়েছি কিন্তু নিশ্চিত জানি, এই অঙ্গবন্ধনের প্রয়োজন আছে... সেইসঙ্গে এ কথাও মনে রাখা চাই যে, চিত্ত দেহে বাস করে বটে কিন্তু দেহকে অতিক্রম করে... এই প্রতিষ্ঠানের কায়া-রূপটির পরিচয় সম্প্রতি আমার কাছে সুস্পষ্ট ও সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু এর চিত্তরূপটির প্রসার আমি বিশেষ করেই দেখেছি তার কারণ, আমি আশ্রমের বাইরে দূরে দূরে বারবার ভ্রমণ করে থাকি।’

২০১৪-তে নতুন শিক্ষানীতি তৈরির যে আভাস কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী দিয়েছেন, তাতে নবীন প্রজন্মের ভাবনার গুরুত্বের কথা আছে। বিশ্বভারতী সেটা কতটা করে?

ভবনে ভবনে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, জ্ঞানের প্রাচীর ভেঙে দিয়ে এই যে বিশ্বভারতীকে একটা অখণ্ড ইউনিট হিসেবে ভাবার চেষ্টা হচ্ছে, তা কী ভাবে রূপায়ণ করা যায় তার ভাবনাটা নবীন শিক্ষকদের কাছ থেকেই আসতে হবে। উপাচার্য বা প্রবীণ সহকর্মীরা শুধু তার অনুঘটকমাত্র।

অর্থাৎ প্রথা ভেঙে ‘ইডিয়ট’দেরই আপনি চাইছেন? বিশ্বভারতী প্রসঙ্গে বলিউড-এর কথা তোলা হয়তো সমীচীন নয়, তবু ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর কথা মনে পড়ছে। রন্ছোড়দাস শ্যামলদাস চাঁচড় কেতাবি ব্যবস্থাটিতেই তলিয়ে গেলে কি বিজ্ঞানী ফুংশুক ওয়াংড়ু হতে পারত?

ঠিক যেমন— নেট বা পিএইচ ডি-র পিছনে দৌড়ে কি এক জন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বা রামকিঙ্কর হওয়া সম্ভব? শিক্ষাতন্ত্রে যাঁরা ‘ইডিয়ট’, আশ্রমের শিক্ষায় তাঁরাই আত্মশক্তিমান! এই সহজ কথাটা এমন সহজ করেই বোঝার সময় এসেছে এখন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন