সম্পাদকীয় ১

দল নামক বিভ্রম

চিনা কমিউনিস্ট পার্টির ৮.৬০ কোটিকে ছাপাইয়া নিজে ৮.৮০ কোটি সদস্য সংখ্যায় পৌঁছাইয়া ভারতীয় জনতা পার্টি বিশ্বরেকর্ড গ়়ড়িয়াছে: এই সংবাদ চতুর্দিকে রাষ্ট্র। একটি খবর অবশ্য ততখানি রাষ্ট্র নয়। তাহা হইল, চিনা কমিউনিস্ট পার্টি আত্মশুদ্ধির তাগিদে আপাতত দলের বহর কমাইতে উদ্গ্রীব, হিসাবনিকাশ করিয়া তাহারা নূতন সদস্য যোগ করিতে এবং সম্ভব হইলে যোগ না করিতেই তাহারা প্রস্তুত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০০
Share:

চিনা কমিউনিস্ট পার্টির ৮.৬০ কোটিকে ছাপাইয়া নিজে ৮.৮০ কোটি সদস্য সংখ্যায় পৌঁছাইয়া ভারতীয় জনতা পার্টি বিশ্বরেকর্ড গ়়ড়িয়াছে: এই সংবাদ চতুর্দিকে রাষ্ট্র। একটি খবর অবশ্য ততখানি রাষ্ট্র নয়। তাহা হইল, চিনা কমিউনিস্ট পার্টি আত্মশুদ্ধির তাগিদে আপাতত দলের বহর কমাইতে উদ্গ্রীব, হিসাবনিকাশ করিয়া তাহারা নূতন সদস্য যোগ করিতে এবং সম্ভব হইলে যোগ না করিতেই তাহারা প্রস্তুত। দলের আকৃতি বৃদ্ধি যে সব সময় শুভ সংবাদ না-ই হইতে পারে, তাহার ইঙ্গিত এই সংবাদে নিহিত। কিন্তু সেই ইঙ্গিত গ্রহণ করিতে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলি বিশেষ ব্যস্ত নয়। তাই বিজেপি-র বিপুল সংখ্যার্জনের খবরে ঈর্ষান্বিত ও তিতিবিরক্ত কংগ্রেস দ্বিমুখী আক্রমণের কর্মসূচি লইয়া অগ্রসর হইতেছে, এক, বিজেপি-র সংখ্যার দাবিটি ভুয়া প্রমাণ করা, এবং দুই, নিজের সদস্য সংখ্যাও মোটে কম নয় তাহা প্রতিষ্ঠা করা। বিজেপি কেবল টুইটার-ফেসবুক-এসএমএস, এমনকী নেহাত মিস্ড কল-এর ভিত্তিতে সংখ্যা বা়ড়াইতেছে, এই সংখ্যার কোনও বাস্তব ভিত্তি নাই: কংগ্রেসের অভিযোগ। বিজেপি নেতারাও বসিয়া নাই। উঠিয়া প়ড়িয়া লাগিয়াছেন নিজেদের সংখ্যামাহাত্ম্য যে ‘ভার্চুয়াল’ নহে, নিতান্ত ‘রিয়াল’ অর্থাৎ বাস্তব, খাতায় কলমে তাহা দেখাইতে।

Advertisement

বিতর্কটি সম্পূর্ণ ভুল দিকে গড়াইতেছে। একবিংশ শতকে কোন ভার্চুয়াল রিয়াল নহে, এবং যাহা রিয়াল তাহার কতটা ভার্চুয়াল নহে, এ সবই বরং বড় প্রশ্ন। কংগ্রেস যতই শতাব্দী-প্রবীণ দল হউক, নিজের গরিমা প্রতিষ্ঠা করিতে যে সংখ্যাতেও গুরু হইতে হইবে, এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অপেক্ষা সদস্যবহরে গুরু-তর হইতে হইবে, ইহা আবশ্যিক বলিয়া মনে হয় না। দলের সদস্য সংখ্যার সহিত যেহেতু ভোট-সংখ্যার সরল আঙ্কিক সম্পর্ক নাই, তাই কোন দলের কত সদস্য বাড়িল কিংবা কমিল, এই কূটকচালি নিতান্তই বিশ-শতকীয় প্রাচীনতার লক্ষণ। দিল্লির সাম্প্রতিক নির্বাচনে আপ-এর জয়ই দেখাইয়া দেয়, কত সামান্য মাপের দল লইয়াও কত অসামান্য নির্বাচনী ফল লাভ করা যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি জায়গাতেই দলের প্রয়োজন। প্রতিনিধি মনোনয়নে। দলের হইয়া যিনি জনতার ভালমন্দ, পছন্দ-অপছন্দের প্রতিনিধিত্ব করিবেন, তাঁহাকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্য দিয়াই আসিতে হইবে, এবং সেই একটি জায়গাতেই একটি সাংগঠনিক পদ্ধতির প্রয়োজন তর্কাতীত। প্রতিনিধি জনসভায় যাইবার পর তাঁহার দল বড় না ছোট, তাই দিয়া তাঁহার জনপ্রিয়তা কিংবা সমর্থন কোনওটিই নির্ধারিত হয় না।

অর্থাৎ দল বস্তুটিই গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রাঙ্গণে অপ্রাসঙ্গিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্তই তাহা বলে। মার্কিন গণতন্ত্র কেবল দ্বিদলীয় নহে, দুই দলের কোনওটিরই বাস্তব ও কেন্দ্রীভূত অস্তিত্ব নাই। দল বিষয়টি একটি ভাবনা, আদর্শ, কার্যক্রম। যে ব্যক্তি এই ভাবনার সহিত নিজেকে যুক্ত করিবেন, তিনিই ‘দল’-এর সদস্য। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উপর্যুপরি আট বৎসর দেশ চালাইবার পরও জানেন না তাঁহার দলের বহর কত বড়, এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলের তুলনায় তাঁহার দল ছোট না ব়়ড়। প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় ‘দল’-এর মনোনয়ন গ্রহণের সীমিত সময় ব্যতীত দল বিষয়টি লইয়া তাঁহারা মাথা ঘামান না। ভারতেও এই ব্যবস্থাই অভিপ্রেত। যে নেতারা মনোনীত হইবেন, তাঁহাদের সহিত সহচর-সহকর্মীরা থাকিবেন, আর থাকিবেন এক ধরনের অনামা অসংবদ্ধ সমর্থকগোষ্ঠী, ঠিক যেমন কোনও সামাজিক আদর্শের প্রেক্ষিতে স্বেচ্ছাসেবক কিংবা মিত্র বাহিনী (যেমন ‘ফ্রেন্ডস অব দি আর্থ’) জড়ো হন, সেই ভাবে। সংখ্যার বাড়াবাড়ি এবং মারামারি ছাড়িয়া বিষয়টি ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি বুঝিলেই মঙ্গল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন