ইউক্রেনের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র হানায় মালয়েশিয়াগামী এক যাত্রিবাহী জেট বিমান সম্পূর্ণ ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। বিমানের যাত্রী ও কর্মী মিলাইয়া ২৯৫ জন আরোহীই নিহত। ইহা কোনও দুর্ঘটনা নয়। ১৯৮৩ সালে দক্ষিণ কোরীয় একটি যাত্রিবাহী বিমানকে যে ভাবে রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র হানায় ধ্বংস করিয়াছিল, এ যেন কতকটা তাহারই পুনরাবৃত্তি। রাশিয়ার নাম এ ক্ষেত্রেও জড়াইয়া গিয়াছে, তবে প্রত্যক্ষ হামলাকারী হিসাবে নয়, ইউক্রেনের বাসিন্দা রুশ বিদ্রোহীদের সমর্থক ও প্রশ্রয়দাতা হিসাবে। সন্দেহ, ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এই বিচ্ছিন্নতাবাদী রুশরাই অপকর্মটির নায়ক। সন্দেহের কারণ, বিগত কিছু কাল ধরিয়াই ইউক্রেনীয় বিমান লক্ষ করিয়া তাহাদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাত্মক পরিণাম এবং ইউক্রেনের আকাশসীমায় প্রবেশ করার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নেতাদের প্রকাশ্য হুঁশিয়ারি। ২৯৫ জন বিমান-আরোহীর মর্মান্তিক নিধনের পর অবশ্য বিদ্রোহীরা ইউক্রেন সরকারের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলিয়াছে। কিন্তু সেটা সম্ভবত কৃতকর্মের দায় হইতে অব্যাহতি পাইতে। নিরপেক্ষ তদন্তেই কেবল প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব এবং অচিরে সেই তদন্ত শুরু করা উচিত।
ইউক্রেন বছরখানেক ধরিয়াই গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। এই প্রজাতন্ত্রে বসবাসকারী রুশরা ইতিপূর্বেই রুশ সহযোগিতায় ক্রাইমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাশিয়ার সহিত যুক্ত করিয়াছে। অতঃপর রুশ-অধ্যুষিত অন্য প্রদেশ ডনেট্স্ক তাহাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘর্ষের কেন্দ্র হইয়া ওঠে। সমগ্র প্রক্রিয়াটির শুরু অবশ্য ইউক্রেন রুশ প্রভাববলয় হইতে মুক্ত হইয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকিবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করার পর। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কোনও ক্রমেই জারের সাবেক রুশ সাম্রাজ্য কিংবা তাহার বলশেভিক উত্তরাধিকার হইতে বিভিন্ন অ-রুশ প্রজাতন্ত্রকে স্বাধীনতা দিতে সম্মত নন। তাই ইউক্রেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ যখন ইউরোপের শরিক হইতে উৎসুক, তখন হইতেই ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ পুতিন নানা ভাবে তাঁহাদের স্বাধিকারপ্রমত্ততা খর্ব করিতে সচেষ্ট হন। তাঁহার ক্রীড়নক প্রেসিডেন্টকে অপসারিত করিয়া ইউক্রেনীয়রা নূতন নির্বাচনের পথে গেলে তাই তাঁহারই প্রচ্ছন্ন সমর্থনে ক্রাইমিয়া ও ডনেট্স্ক সহ ইউক্রেনের বিভিন্ন রুশ-অধ্যুষিত অঞ্চল বিচ্ছিন্নতাবাদের পথ গ্রহণ করে। ক্রাইমিয়া আলাদা হওয়ার পর এ বার ডনেট্স্ক-এর পালা। সেখানে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সহিত রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ধুন্ধুমার সংঘর্ষে লিপ্ত। এই লড়াইয়ে ইতিমধ্যেই একাধিক ইউক্রেনীয় সামরিক বিমান দ্রোহীদের ক্ষেপণাস্ত্রে ভূপাতিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত। রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করিয়াই দ্রোহীরা এই সাফল্য পাইতেছে। মালয়েশীয় বিমানটি ধ্বংস হওয়ার ক্ষেত্রেও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভূমিকা এ জন্য উড়াইয়া দেওয়া কঠিন।
বিমানযাত্রীদের মধ্যে দেড় শতাধিক নেদারল্যান্ডস-এর নাগরিক. মার্কিন, ফরাসি, জার্মানরাও আছেন। নেদারল্যান্ডস রাশিয়ার সঙ্গে নিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্কে বদ্ধ। জার্মানি ও ফ্রান্সও ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির মার্কিন উদ্যোগে শামিল হইতে দ্বিধাগ্রস্ত। নেদারল্যান্ডস-এর রাষ্ট্রপ্রধান এই ঘটনাটিকে ‘জাতীয় শোক’ বলিয়া বিবৃত করিয়াছেন। জার্মানি ও ফ্রান্সের উপরেও নিশ্চয় অপকাণ্ডের প্রভাব পড়িবে। উহারা রুশ যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান লইতে মার্কিন উদ্যোগে শরিক হইবে কি না, তাহা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ইউরোপীয় দেশগুলিতে জনমত নিশ্চিতরূপেই ইউক্রেনে ভাঙন ধরানোর রুশ তৎপরতার পরিণাম রূপে রুশ দ্রোহীদের এই ক্ষেপণাস্ত্র হানাকে গণ্য করিবে এবং ধিক্কার জানাইবে। তদন্ত যাহাই উন্মোচন করুক, নৈতিক দায় পুতিন এড়াইতে পারেন না।