প্রবন্ধ ২

ন্যায্য মূল্যের ওষুধ সত্যিই খরচ কমাচ্ছে

জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখা আর সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত ওষুধের সরবরাহেও রীতিমত উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য নীতিতে নতুন যে উদ্যোগগুলি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বহু আলোচনা হয়েছে, তার অন্যতম ন্যায্য মূল্যের ওষুধ। ২০১২ সালের শেষ থেকে সরকারি হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান খোলার কাজ শুরু হয়। তার পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, সত্যিই কি এতে রোগীদের ওষুধের জন্য খরচ কমবে? না কি ছাড় দেওয়ার পরেও ‘জেনেরিক’ ওষুধ যে দামে বিক্রি করে ন্যায্য মূল্যের দোকান, বাইরে অন্য নির্মাতার তৈরি সেই একই ওষুধ পাওয়া যায় অনেক কম দামে?

Advertisement

অরিজিতা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share:

পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য নীতিতে নতুন যে উদ্যোগগুলি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বহু আলোচনা হয়েছে, তার অন্যতম ন্যায্য মূল্যের ওষুধ। ২০১২ সালের শেষ থেকে সরকারি হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান খোলার কাজ শুরু হয়। তার পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, সত্যিই কি এতে রোগীদের ওষুধের জন্য খরচ কমবে? না কি ছাড় দেওয়ার পরেও ‘জেনেরিক’ ওষুধ যে দামে বিক্রি করে ন্যায্য মূল্যের দোকান, বাইরে অন্য নির্মাতার তৈরি সেই একই ওষুধ পাওয়া যায় অনেক কম দামে? সেই সঙ্গে রয়েছে উদ্বেগ, ন্যায্য মূল্যের দোকানগুলিতে পাওয়া ওষুধগুলি কি নিম্নমানের বলেই কম দামে মিলছে?

Advertisement

এই প্রশ্নগুলির উত্তর পেতে আমার সহকর্মী বেথুন কলেজের শিক্ষক শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমি একটি সমীক্ষা শুরু করি ২০১৩ সালে। তা থেকে প্রাপ্ত ফলের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই নিবন্ধ। তবে তার আগে একটা ‘মুখবন্ধ’ বোধহয় জরুরি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ রাজ্যের অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারি কোনও নীতির সমালোচনা করলে বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের তকমা মেলে। আবার নীতির সাফল্য তুলে ধরলে শাসক দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে আখ্যা জোটে। এই প্রবন্ধে আলোচিত সমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব গবেষণালব্ধ— রাজনীতির উপরে উঠে নৈর্ব্যক্তিক আলোচনামাত্র।

জাতীয় নমুনা সমীক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ প্রকাশিত স্বাস্থ্য সমীক্ষায় (২০০৪-২০০৫) দেখা যায়, ভারতে সরকারি হাসপাতালেও ওষুধ, নানা পরীক্ষা, রক্ত, ফিজিয়োথেরাপি, কিমোথেরাপি প্রভৃতির জন্য যথেষ্ট খরচ করতে হয় পকেট থেকে। সেই সঙ্গে আছে হাসপাতালে যাতায়াত, রোগীর আত্মীয়দের থাকা-খাওয়া, আয়া রাখা, ঘুষ দেওয়ার খরচ। এই সবের জন্য পকেট থেকে যে টাকাটা রোগীকে খরচ করতে হয়, এ রাজ্যে তা গড় বাৎসরিক আয়ের ৬.১৫ শতাংশ, যা ভারতের গড়ের (৫.৫) থেকে বেশি। পকেট-খরচের টাকার ৬৬ শতাংশই চলে যায় ওষুধ কিনতে। এ রাজ্যে একটি সমীক্ষায় (২০১০-১১) দেখা যায়, এ রাজ্যের জেলা স্তরের হাসপাতালগুলিতে বিনামূল্যে খুব সামান্য ওষুধই মেলে। রোগীদের যখন প্রশ্ন করা হয় যে সর্বপ্রথম কী উন্নতি করা উচিত, ৯৫ শতাংশই ওষুধের জোগানে উন্নতি দাবি করেন।

Advertisement

এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যবাসীর পকেট-খরচ কমাতে মূলত তিনটি নীতি গ্রহণ করে। ১) সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যের ওষুধের জোগান বাড়াতে বরাদ্দ বাড়ানো। ২) সরকারি ডাক্তারদের চাপ দিয়ে ওষুধের ‘জেনেরিক’ নামে প্রেসক্রিপশন লেখা। ৩) জেলা ও রাজ্য স্তরের হাসপাতালে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান খোলা।

এই তৃতীয় উদ্যোগটির সার্থকতা নিয়েই এই সমীক্ষা। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ৯৪টি এমন দোকান খোলা হয়েছে, যেখানে প্রাথমিক ভাবে ১৪২ রকম ওষুধ ‘জেনেরিক’ বা ‘ব্র্যান্ডেড জেনেরিক’ সংস্করণে রাখতে হবে (‘ব্র্যান্ডেড জেনেরিক’ ওষুধে নির্মাতার নাম ও ওষুধের জেনেরিক পরিচয়, দুটোই লেখা থাকে। খুচরো বিক্রেতাদের কাছে এই ধরনের ওষুধ অনেক কম দামে বিক্রি করে নির্মাতা। কারণ নির্মাতারা এই ওষুধগুলির বিজ্ঞাপন বা প্রচারে টাকা ব্যয় করে না। সরকারি ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানে ছাপানো দামের ওপর ৪৮-৭৭ শতাংশ ছাড় পাওয়া যায়)।

প্রাথমিক (‘বেসলাইন’) সমীক্ষার পর ২০১৪ সালে মূল সমীক্ষা হয় ৯টি সরকারি হাসপাতালের দু’হাজার রোগীর উপর। তাঁদের অর্ধেক আউটডোরে দেখাতে এসেছিলেন, অর্ধেক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের বিক্রির নিরিখে খুব ভাল (এসএসকেএম এবং বারাসত জেলা হাসপাতাল), মাঝামাঝি (চিত্তরঞ্জন মেডিক্যাল কলেজ, বাঁকুড়া সম্মেলনী, বালুরঘাট জেলা হাসপাতাল ও কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতাল) এবং খুব খারাপ (বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ও জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতাল) এবং একটি মহকুমা হাসপাতাল (বারুইপুর)— মোট ৯টি হাসপাতাল নেওয়া হয়। রোগীদের সঙ্গে কথা বলা হয়, তাঁদের সমস্ত প্রেসক্রিপশন ও বেডহেড টিকিট কপি করা হয়। পাশাপাশি, কথা বলা হয় সংশ্লিষ্ট দোকানে ও হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে।

মিলছে ওষুধ

এক, হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যের ওষুধ পাওয়ার যাচ্ছে বেশি। ২০১৩ সালে ৩৩ শতাংশ ওষুধ ফ্রি মিলছিল, ২০১৪ সালে মিলছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। এই নিরিখে সবার পিছনে এসএসকেএম। সেখানে ভর্তি রোগীরা মাত্র ১০ শতাংশ ওষুধ ফ্রি পাচ্ছে।

দুই, গড়ে ৬০ শতাংশ ওষুধ জেনেরিক নামে লিখছেন ডাক্তাররা। অর্ধেকের বেশি জেনেরিক ওষুধ হলেই যথেষ্ট ভাল বলতে হবে। এই নিরিখে সবার উপরে বালুরঘাট জেলা হাসপাতাল। সেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ ওষুধই জেনেরিক নামে লেখা হচ্ছে।

তিন, রোগীর পকেট খরচ কমছে। ‘ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট মেথডলজি’ ব্যবহার করে দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে যাঁরা ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানে যাচ্ছেন, তাঁদের খরচ যাঁরা যাচ্ছেন না তাঁদের চেয়ে গড়ে ৩০ শতাংশ কম হচ্ছে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু রোগী (ভর্তি রোগীর ৪৩ শতাংশ, আউটডোর রোগীর ৪৭ শতাংশ) এখনও ন্যায্যমূল্যের দোকানে যাচ্ছেন না। তার তিনটি প্রধান কারণ পাওয়া যাচ্ছে। এক, অনেকে এ সম্পর্কে জানেন না। দুই, আগে কখনও এই দোকানে ওষুধ কিনতে গিয়ে নির্দিষ্ট ওষুধ পাননি, তাই আর যাচ্ছেন না। তিন, ওষুধের মান সম্পর্কে সন্দেহ। দেখা যাচ্ছে, যাঁরা অনেক দিন হাসপাতালে আছে, যাঁরা গুরুতর অসুখে ভুগছেন, এবং যাঁদের প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক লেখা হচ্ছে বেশি, তাঁরাই এই দোকানগুলিতে বেশি যাচ্ছেন।

সমস্যা থাকছে হাসপাতালের দিক থেকেও। বেশ কিছু হাসপাতালে রোগীরা জানিয়েছেন, ডাক্তার সাদা চিরকুটে ব্র্যান্ডেড ওষুধের নাম লিখে দিচ্ছেন, সেই সব ওষুধের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে না বেডহেড টিকিটে। আরও ভয়ঙ্কর সমস্যা, ডাক্তার ও নার্সদের একাংশ (অধিকাংশ নয়) রোগীদের ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানে যেতে বারণ করছেন।

ন্যায্য মূল্যের ওষুধের মান কেমন? ফার্মাকোলজিক্যাল পরীক্ষার নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। তেমন পরীক্ষা হয়ে থাকলে তার ফল অবশ্যই জনসমক্ষে আনা উচিত সরকারের। কিন্তু এ প্রশ্নটা এখনই এত বড় হয়ে উঠছে কেন, সে কথাটাও ভাবা দরকার। ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলি বহু দিন ধরে ‘ব্র্যান্ডেড জেনেরিক’ ওষুধ উৎপাদন করছে, প্রধানত হাসপাতালে জোগানের জন্য। এত দিন চিকিৎসকরা কেন সেই সব ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি? দাম কমার পরেই মান নিয়ে এত সংশয় কেন? আশঙ্কা হয়, রোগীর নিরাময়ের চাইতেও কমিশনে টান পড়ার চিন্তায় চিকিৎসকদের একাংশ বেশি উদ্বিগ্ন।

দাম বনাম মান

গত এক বছর একটা বিতর্ক বার বার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। তা হল, জেনেরিক ওষুধ লিখলে ব্র্যান্ড নির্বাচনের ক্ষমতা ডাক্তারবাবুর হাত থেকে ন্যায্যমূল্যের দোকানদারের হাতে চলে যায়। একই জেনেরিক ওষুধের অনেক ব্র্যান্ড আছে, দামেরও ফারাক প্রচুর। তাই চড়া দামের ব্র্যান্ডের জেনেরিক ওষুধই দেবেন দোকানি, সে সম্ভাবনা থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে দামে ছাড় দিয়েও বিক্রয়মূল্য যা হবে, তার থেকে বাইরের দোকানে কম দামে ওই ওষুধ পাওয়া যেতে পারে, আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।

এমন হচ্ছে কি না, বুঝতে আমরা সমীক্ষা করলাম, ন্যায্যমূল্যের দোকানে ৫০টি সর্বাধিক ব্যবহৃত জেনেরিক ওষুধের (ব্র্যান্ড বা ব্র্যান্ডহীন) দাম কত। তার সঙ্গে বাজারে সর্বাধিক বিক্রীত (Fast Moving) ব্র্যান্ডের দামের তুলনা করে দেখা গেল, প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে ন্যায্যমূল্যের দোকানের ওষুধের দাম ওই সর্বাধিক বিক্রীত ব্র্যান্ডের থেকে যথেষ্ট কম!

এই সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই নীতি সাধারণ রোগীর ওষুধের খরচ বেশ খানিকটা কমাতে পেরেছে। জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখা আর সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত ওষুধের সরবরাহেও যথেষ্ট উন্নতির লক্ষণ আছে। কী করে এটা সম্ভব হল? এই গবেষণার কাজ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, এ বিষয়ে স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকদের একটা দায়বদ্ধতা জোরালো ভাবে কাজ করছে। চিকিৎসকদের একাংশের বাধা সত্ত্বেও, আধিকারিকদের লাগাতার প্রচেষ্টার জন্যেই কম দামে ওষুধ সরবরাহের পরিকল্পনা অনেকটাই সফল হতে পেরেছে। এ বার বোধহয় ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে নিয়মিত নজরদারি বা ‘সোশ্যাল মনিটরিং’ ব্যবস্থা শক্ত করা দরকার। তা হলে সুফলগুলো দীর্ঘস্থায়ী হবে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন