সম্পাদকীয় ২

নিরাবরণ

নারী-নিগ্রহের প্রতিবাদ করিলে এখন পশ্চিমবঙ্গে নিগ্রহকারীদের হাতে প্রহৃত, রক্তাক্ত, নিহত হইতে হয়। কারণ নিগ্রহকারী দুষ্কৃতীদের পুলিশ গ্রেফতার করে না। তাহারা শাসক দলের আশ্রিত সমাজবিরোধী হইলে তো কথাই নাই। সে ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করিতেও থানা গড়িমসি করে, প্রায়শ ‘আপসে মিটাইয়া লইতে’ পরামর্শ দেয়। এই অস্বাস্থ্যকর প্রবণতা অতীতেও ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে তাহা অতিমাত্রায় প্রকট হইয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share:

নারী-নিগ্রহের প্রতিবাদ করিলে এখন পশ্চিমবঙ্গে নিগ্রহকারীদের হাতে প্রহৃত, রক্তাক্ত, নিহত হইতে হয়। কারণ নিগ্রহকারী দুষ্কৃতীদের পুলিশ গ্রেফতার করে না। তাহারা শাসক দলের আশ্রিত সমাজবিরোধী হইলে তো কথাই নাই। সে ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত করিতেও থানা গড়িমসি করে, প্রায়শ ‘আপসে মিটাইয়া লইতে’ পরামর্শ দেয়। এই অস্বাস্থ্যকর প্রবণতা অতীতেও ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে তাহা অতিমাত্রায় প্রকট হইয়াছে। দলদাস পুলিশ রাজনৈতিক নেতাদের হুকুম না পাইলে নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষায় তৎপর হয় না। দল-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের শাসন করার তো প্রশ্নই ওঠে না। পুলিশকে আর দুষ্টের দমনে কিংবা শিষ্টের পালনে সক্রিয় হইতে হয় না। হাওড়ার সালকিয়ায় দুষ্কৃতীদের প্রাণঘাতী হামলায় আশঙ্কাজনক অবস্থায় যখন পাঁচ দিন ধরিয়া অরূপ ভাণ্ডারী মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়িতেছিলেন, সেই দীর্ঘ অবকাশেও পুলিশ অভিযুক্ত পাঁচ দুষ্কৃতীর এক জনকেও ধরিতে ‘পারে নাই’। এখন অরূপের অকালমৃত্যুর পর স্থানীয় বাসিন্দাদের তীব্র ক্রোধ পুঞ্জীভূত হওয়ায় তড়িঘড়ি শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্ব পুলিশকে তৎপর হইতে বলিতেছে।

Advertisement

এই সূত্রেই লক্ষ করা গেল এক ন্যক্কারজনক প্রবণতা: নিহত অরূপের মৃতদেহ লইয়া নোংরা রাজনীতির খেলা। যে দলের কাউন্সিলর হইতে বিধায়ক পর্যন্ত কোনও স্তরের কর্মকর্তা গত পাঁচ দিনে অরূপের চিকিৎসা বিষয়ে খোঁজখবর পর্যন্ত করেন নাই, তাঁহারাই মৃত্যুসংবাদ পাওয়া মাত্র নিহত যুবকের বাড়ি ও পাড়া ঘিরিয়া ফেলেন, শত শত কর্মী লইয়া শ্মশানযাত্রায় যোগ দেন, অরূপকে নিজ দলের কর্মী হিসাবে দাবি করেন, অন্য দলের নেতাদের সরজমিনে অকুস্থলে গিয়া নিহতের পরিবারবর্গকে সমবেদনা জানাইতেও বাধা দেন। এই কুনাট্য হয়তো বা নাগরিকের মনে আর এক বিপন্ন বিস্ময় জাগ্রত করিয়াছে: নিহত অরূপ যদি শাসক দলের কর্মী হইবে, তবে তাঁহার আক্রমণকারীদের বাঁচাইতে দল ও উর্দিধারী দলদাসদের এত তৎপরতা কেন?

লাশ দখলের এই কলুষিত রাজনীতি অতীতেও দেখা গিয়াছে। কখনও দলীয় ভৈরবদের বিক্রমে বিব্রত শাসক দলের নেতারা মৃতদেহ দখলের কাজে দলদাস পুলিশকেও ব্যবহার করিয়াছেন, শ্মশান ঘেরাও করিয়া মৃতের অন্ত্যেষ্টি নিয়ন্ত্রণ করার অমানবিকতাও দেখাইয়াছেন। বামফ্রন্ট তথা সিপিআইএমই ইহার স্রষ্টা। কিন্তু অন্য বিবিধ ক্ষেত্রের মতোই এ ক্ষেত্রেও সে আমলে একটি কাঠামোর মধ্যে, একটি পদ্ধতি মানিয়া মানুষকে বিভ্রান্ত করা হইত, লাশ দখলেরও একটি সুচিন্তিত (কিংবা, কুচিন্তিত) কৌশল থাকিত। বর্তমান শাসকরা সেই সকল কৌশল করিতে পারেন না, বোঝেন বলিয়াও মনে হয় না, তাঁহারা পুরানো মডেলটিকে একেবারে নিরাবরণ এবং উৎকট চেহারায় প্রয়োগ করিতে তৎপর। ইহাকে তাঁহারা ‘স্বচ্ছতা’ বলিয়া গৌরব করিতে পারেন, যাহার যাহাতে গৌরববোধ হয়! কিন্তু এই নির্লজ্জ কুরাজনীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গের সমাজের যে অচিন্তনীয় ক্ষতি সাধিত হইতেছে, তাহা পূরণ হইতে কত যুগ কাটিয়া যাইবে, বলা দুষ্কর। রাজনীতিতে অনৈতিকতার প্রভাব প্রতিপত্তি নূতন নহে, পশ্চিমবঙ্গের একার সমস্যাও নহে, কিন্তু অনৈতিকতাকেই ঢাক পিটাইয়া রাজনীতি হিসাবে তুলিয়া ধরিবার মধ্যে যে বিপুল গ্লানি আছে, তাহা উপলব্ধি করিবার সামর্থ্য পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদের আছে কি?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন