ইরাকের পার্লামেন্টে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়াছে। ২০১১ সালে মার্কিন বাহিনী ইরাক হইতে ঘরে ফেরার পর ইহাই ছিল ইরাকি সংসদের প্রথম নির্বাচন। নির্বাচনকে উপলক্ষ করিয়া দেশবাসীর মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনাও লক্ষ করা গিয়াছে, বিশেষত মহিলা ভোটারদের মধ্যে। তবে জাতিবৈর ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ ইরাকের জনসাধারণ এখন আর নূতন সূর্যোদয়ের প্রত্যাশা করেন না। তাঁহারা একপ্রকার ধরিয়াই লইয়াছেন যে, সাদ্দাম হুসেন-উত্তর ইরাক যে অন্ধকারের চোরাবালিতে নিমজ্জিত হইয়াছে, সেখান হইতে উদ্ধারের বিশেষ সম্ভাবনা নাই। বিশেষত শিয়া, সুন্নি এবং কুর্দ জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক বৈরিতা, অবিশ্বাস, বিদ্বেষ এবং হিংসার আবহে যাহারাই ক্ষমতাসীন হউক, স্থায়ী শান্তি, সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে দেশকে টানিয়া লওয়া দুরূহ কর্ম বলিয়াই প্রতিভাত হইবে।
সাদ্দাম হুসেনের জমানায় সংখ্যালঘু আরব সুন্নিরা ছড়ি ঘোরাইয়াছে। মার্কিন হস্তক্ষেপে সাদ্দামের অপসারণ এই বিকৃতি সংশোধন করিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষমতাসীন হওয়ার পথ প্রশস্ত করে। সেই সূত্রেই শিয়া নেতা নুরি আল-মালিকি রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন। কিন্তু সুন্নি এবং কুর্দরা ইহা ভাল মনে মানিয়া লয় নাই। ফলে রামাদি ও ফালুজার মতো সুন্নি-অধ্যুষিত অঞ্চল ও জনপদগুলিতে সরকার-বিরোধী অন্তর্ঘাত ও নাশকতা সুন্নি মৌলবাদ ও জেহাদি সন্ত্রাসের হাত ধরিয়া বিস্ফোরিত হয়। আল-কায়দার বিভিন্ন গোষ্ঠী ইরাকে সক্রিয় হইয়া ওঠে। এই অবস্থায় প্রতিবেশী ইরানের শিয়া নেতৃত্ব প্রাথমিক পর্বে ইরাকি জ্ঞাতিভ্রাতাদের সাহায্যে আগাইয়া আসিয়াছিলেন। অন্তত ইরাকি শিয়াদের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তাহাতে কিছুটা চাপা ছিল। কিন্তু ক্রমে ইরানের মধ্যস্থতা ঘুচিয়া যায় এবং ধর্মীয়, জনজাতীয়, এমনকী জাতিসত্তাগত বিরোধও ইরাকে একটি ঐকমত্যের সরকার গড়ার যাবতীয় সম্ভাবনা নিঃশেষ করিয়া দেয়। সুন্নি জেহাদিদের আক্রমণে শিয়াদের নিধন নিয়মিত ব্যাপার হইয়া ওঠে। গত বছর মে মাস হইতে প্রতি মাসে গড়ে এক হাজার অসামরিক ব্যক্তি জেহাদি হামলায় প্রাণ হারাইয়া চলিয়াছেন। অধিকাংশ আক্রমণেরই লক্ষ্যবস্তু কারবালা-সহ শিয়া ধর্মস্থানে সমবেত পুণ্যার্থীরা, ফিদাইন আল-কায়দা গোষ্ঠীর বোমারু হামলায় যাঁহাদের শব ইতস্তত ছড়াইয়া পড়িতেছে। কুর্দরা এই দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ। স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তানের নিশ্চয়তা ছাড়া অন্য কিছুতে তাঁহারা আগ্রহী নহেন।
প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকি এই তৃতীয় বারেও জয়ী হওয়ার আশা রাখেন। কিন্তু তিনি নিজের সাফল্যকে নিজ গোষ্ঠীর শিয়া রাজনীতিকদের কর্তৃত্ব একচ্ছত্র করার সমার্থক বলিয়া গণ্য করেন, দেশের সব জনগোষ্ঠী লইয়া একটি ঐকমত্যের সরকার কায়েম করা তাঁহার লক্ষ্য নয়। তিনি পুনর্নির্বাচিত হইলে দেশে হিংসা হানাহানি ও রক্তক্ষয় বন্ধ হইবে, এমন কোনও প্রতিশ্রুতিও তাঁহার নাই। স্বভাবতই জনসাধারণ শাসনব্যবস্থার কোনও কাঠামোগত সংস্কারের প্রত্যাশা করিতেছেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রী হইলেও বাগদাদের পরিসীমার বাহিরে বিস্তৃত মেসোপটেমীয় ভূখণ্ডে বিভিন্ন জেহাদি গোষ্ঠী আগের মতোই দাপাইয়া বেড়াইবে। ইরাক ও ‘বৃহত্তর সিরিয়া’ (জর্ডন-সহ) লইয়া একটি জেহাদি রাষ্ট্র গড়ার যে কর্মসূচি আল-কায়দার জঙ্গিরা লইয়াছে, দ্রুত তাহা কার্যকর করার দিকে অগ্রসর হইবে। ইরান ও প্যালেস্টাইনকে চাপে রাখিতে গিয়া এবং ইজরায়েলকে তুষ্ট করিতে গিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই বিপদটি উপেক্ষা করিয়া চলিয়াছে। পার্লামেন্ট নির্বাচন তাই ইরাকে কোনও গণতান্ত্রিক পালাবদল সূচিত করিবে না।