প্রথা বা ঐতিহ্য কি কোনও অন্যায় চিরস্থায়ী করার ছাড়পত্র হইতে পারে? প্রশ্নটি উঠিয়াছে ‘জাল্লিকাট্টু’ উপলক্ষে। তামিলনাড়ুতে ফসল কাটার পোঙ্গল উত্সবের অঙ্গ হিসাবে জাল্লিকাট্টু নামে ষাঁড়ের সহিত মানুষের লড়াই-খেলা জনপ্রিয়। গত বছর সুপ্রিম কোর্ট এই খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইহা তামিল ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এই অজুহাতে শীর্ষ আদালতের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার দাবি উঠিয়াছে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী পানিরসেলভান এই মর্মে কেন্দ্রের কাছে আর্জি জানাইলে বিরোধী ডিএমকে-র সর্বাধিনায়ক এম কে করুণানিধিও একই দাবিতে মুখর হইয়াছেন, পাছে এডিএমকে সরকার এই মর্মে অর্জিত কোনও সাফল্য একা দাবি করিয়া বসে। একদা রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারে সিংহ ও বাঘের সহিত গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই উপভোগ করিতে দর্শকাসন ভরিয়া যাইত। স্পেনে ষাঁড়ের সহিত ম্যাটাডরের লড়াই এখনও অন্যতম প্রধান বিনোদন, যাহাতে একাধিক বর্শাসজ্জিত যোদ্ধা একটি ষাঁড়কে বিদ্ধ, রক্তাক্ত করিতে মল্লভূমিতে অবতীর্ণ হয়। পশুপ্রেমী এবং পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির প্রবক্তারা এই ক্রীড়ামোদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর। কিন্তু প্রথা ও ঐতিহ্যের দোহাই দিয়া এখনও ওই ষাঁড়ের লড়াই যথারীতি চলিয়াছে।
সুপ্রিম কোর্ট দেখিয়াছিল, এই তথাকথিত উত্সবে ষাঁড়েরা যেমন আহত, ক্ষতবিক্ষত হয়, তাহা অপেক্ষা বেশি আহত হন খেলায় যোগ দেওয়া উত্সাহী যুবকরা। গত দুই দশকের হিসাব লইলে এই মারণক্রীড়ায় নিহতের সংখ্যা দুই শতাধিক, আহত বা নিহত ষাঁড়ের হিসাব লওয়ার চেষ্টা হয় নাই। তাড়া-খাওয়া ষাঁড় যখন জনতার মধ্য দিয়া রুদ্ধশ্বাসে, প্রাণভয়ে দৌড়াইতে থাকে, তখনই তাহাকে শিঙ ধরিয়া থামাইবার চেষ্টায় এই অপঘাত মৃত্যুগুলি ঘটিয়া থাকে। এই ক্রীড়ামোদের মধ্যে যেমন ষাঁড়ের প্রতি অমানবিক নিষ্ঠুরতা রহিয়াছে, তেমনই বিনোদনের নামে বেঘোরে প্রাণহানির ঝুঁকিও থাকে বিলক্ষণ। এই সব বিবেচনা করিয়াই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিবেকবান কিছু ব্যক্তি এই মারণখেলা নিষিদ্ধ করার আর্জি জানান। কিন্তু রাজ্যের শাসক ও বিরোধী উভয় পক্ষের রাজনীতিকরাই ঐতিহ্য, প্রথা ও সংস্কৃতির দোহাই পাড়িয়া জাল্লিকাট্টু ফিরাইয়া আনার জন্য সওয়াল করিতেছেন!
সহজ কথা ইহাই যে, ঐতিহ্য কিংবা প্রাচীনত্ব কোনও মতেই একটি অন্যায় প্রথার স্থায়িত্বের রক্ষাকবচ হইতে পারে না। সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে যেমন কুসংস্কার ও কুপ্রথার প্রাচীন নিগড় ভাঙিয়া ফেলিতে হয়, তেমনই আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত সামাজিক চেতনা ও বিবেক অকারণ নিষ্ঠুরতার অনুশীলন হইতেও আপনাকে প্রত্যাহার করিয়া লয়। ষাঁড় মানুষের গৃহপালিত পশুর মধ্যেই পড়ে। তাহাদের এই ভাবে আমোদ-প্রমোদের উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করার জন্য প্রতিপালন করা, বড় হইলে সমবেত যূথবদ্ধ আমোদিত জনতার উচ্ছৃঙ্খল বিতাড়ন ও নিগ্রহের শিকার করিয়া তোলা নিশ্চিত ভাবেই অন্যায়। অবোধ প্রাণীটির প্রতি নিষ্ঠুরতাও এই ক্রীড়ায় পর্যাপ্ত। উত্সবের নামে এমন নিষ্ঠুর আমোদ মানুষের মানবিক মহিমা বৃদ্ধি করে না। জীবকুলের শ্রেষ্ঠ হওয়ার সুবাদে মনুষ্যেতর জীবদের প্রতি নিষ্ঠুরতার মধ্যে যে বিনোদন, তাহা এক দুর্ভাগ্যজনক মানসিকতার পরিচায়ক। পানিরসেলভান কিংবা করুণানিধি সেই মানসিকতায় অগ্রবর্তী হইবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না-ই বা অবতীর্ণ হইলেন!