নি য়ন্ত্রণ এবং নিষেধাজ্ঞা এক নহে। নরেন্দ্র মোদীর সরকার কি তাহা জানে? বোঝে? কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সারোগেসি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রস্তাবিত বিল অনুমোদন করিয়া গর্ভ ভাড়া দিবার প্রক্রিয়াটিতে নীতি ও নিয়মের লাগাম পরাইতে উদ্যোগী। উদ্যোগের কারণ আছে। অন্যের গর্ভে আপন সন্তান উৎপাদনের প্রযুক্তি ব্যবহার করিয়া ঢালাও ব্যবসা চলিতেছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। এই অন্যায় রোধের নিমিত্ত নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। যে মহিলারা গর্ভ ভাড়া দিয়া থাকেন, তাঁহাদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখিবে প্রস্তাবিত আইন, দারিদ্রের সুযোগ লইয়া তাঁহাদের উপর যে শোষণ চলিতেছে তাহা বন্ধ হইবে। যাঁহারা গর্ভ ভাড়া করেন, কঠোর আইনের খুঁটিনাটি শর্ত পূরণ করিয়া তবেই তাঁহারা গর্ভ ভাড়া করিবার সুযোগ পাইবেন। যেমন, কন্যাসন্তানকে অনেক দম্পতি গ্রহণ করিতে চাহে না। আবার, কোনও বিদেশি দম্পতি গর্ভদাত্রীর সহিত প্রতারণা করিলে তাহাদের নাগাল পাওয়া কঠিন হয়। সরকার এই রকমারি অন্যায়ে রাশ টানিতে চাহে।
কিন্তু টানের কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি হইয়াছে। প্রস্তাবিত আইন কার্যকর হইলে বাণিজ্যিক সারোগেসি পাইকারি ভাবে নিষিদ্ধ হইবে। কেবল নিকটাত্মীয় গর্ভদাত্রী হইতে পারিবেন— ‘আত্মীয়’ কাহাকে বলে, তাহা অবশ্য আইন-প্রস্তাবে খোলসা করিয়া বলিয়া দেওয়া নাই। বিদেশিরা আদৌ ভারতে গর্ভদাত্রী পাইবেন না। অবিবাহিত বা সমকামী দম্পতি কিংবা একক পিতা বা মাতাও তথৈবচ। আরও অনেক বাধায় এবং শর্তে বিলটি কণ্টকিত। ইহা নিয়ন্ত্রণ নহে, নিষেধাজ্ঞা। এই বিধান এক দিকে গর্ভদাত্রীর স্বাধীনতা খর্ব করিবে, অন্য দিকে বহু নিঃসন্তান দম্পতিকে বঞ্চিত করিবে, তাঁহাদের ইচ্ছা এবং চাহিদাকে অস্বীকার করিবে। মাতৃত্বকে কেন্দ্র করিয়া অসৎ ব্যবসা বন্ধ করিবার অজুহাতে মৌলিক ব্যক্তিস্বাধীনতা লঙ্ঘনের কোনও অধিকার রাষ্ট্রের থাকিতে পারে না। যে কোনও সুযোগের অপব্যবহার হইতে পারে, সেই যুক্তিতে সুযোগটিকেই বন্ধ করিয়া দেওয়া চলে না। দোষীদের ধরা কঠিন বলিয়া নির্দোষ নাগরিক বা বিদেশিরা অন্যায় নিষেধাজ্ঞার শিকার হইবেন কেন? যদি যুক্তিযুক্ত নিয়ন্ত্রণকে ঠিক মতো কার্যকর করিতে না পারা যায়, তাহা সরকারের অক্ষমতা। নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়া তাহার সমাধান হয় না। নূতন বিধিরও যে অপব্যবহার ঘটিবে না, তাহার কী নিশ্চয়তা আছে?
এই আইন-প্রস্তাবের পিছনে কাজ করিতেছে মান্ধাতা আমলের তমসাচ্ছন্ন মানসিকতা। বিদেশমন্ত্রীর বিভিন্ন মন্তব্যে সেই মানসিকতা অতি প্রকট। দুর্ভাগ্যের কথা, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হয়তো এই মানসিকতাই পোষণ করেন। একক অভিভাবক বা সমকামীরা গর্ভ ভাড়া করিতে পারিবেন না কিংবা নিকটাত্মীয় না হইলে গর্ভদাত্রী হওয়া চলিবে না— এই বাধানিষেধগুলিকে হয়তো দেশের বহু মানুষ, সুষমা স্বরাজের মতোই, ‘আমাদের ঐতিহ্য’ বলিয়াই মনে করেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চাহিলেও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে হত্যা করা হইবে কোন যুক্তিতে? বস্তুত, একটি সমকামী দম্পতি বা এক জন একক অভিভাবকও যদি সন্তানের জন্য গর্ভ ভাড়া করিতে চাহেন, এক জন নারীও যদি আপন গর্ভ দান করিতে বা ভাড়া দিতে চাহেন, তাঁহাদের বঞ্চিত করিবার অধিকার কোন গণতন্ত্র রাষ্ট্রকে দিয়াছে? সংখ্যাগুরুবাদ এবং পশ্চাদ্মুখী মনোবৃত্তির রসায়ন মোদী জমানার অভিজ্ঞান। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রে সরকারি নীতিতে তাহা প্রকট। এই রসায়নে গরল উৎসারিত হইবে, তাহা অবধারিত। ব্যক্তির অধিকার, বিশেষত যে ব্যক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুসারী না হইয়া নিজের মতো বাঁচিতে চাহেন তাঁহার অধিকারকে মারিয়া ফেলিতে সেই বিষের জুড়ি নাই। জবরদস্ত আইন হাতে থাকিলে হেমলকের প্রয়োজন কী?