পশ্চিমবঙ্গ নামক কুরুক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া বঙ্গেশ্বরী দার্শনিক প্রজ্ঞায় ঘোষণা করিতে পারেন, দুষ্কৃতীর পরিত্রাণ ও সাধারণ মানুষের বিনাশার্থেই তাঁহার আবির্ভাব হইয়াছে। অবশ্য, তিনি স্বমুখে না বলিলেও চলিবে, তাঁহার প্রশাসন কথাটির যাথার্থ্য প্রমাণ করিয়া ছাড়িয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ইস্তক তাঁহার দলের দুষ্কৃতীদের সব বিপদ হইতে রক্ষা করাই পুলিশের প্রধানতম দায়িত্ব হইয়াছে। সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করিয়া দুইটি ঘটনায় তাহা আরও এক বার প্রমাণিত। দমদমে প্রৌঢ় শিল্পী-দম্পতি পাড়ার ‘তাজা ছেলেদের’ মধ্যরাত্রের মোচ্ছবে বিধ্বস্ত হইয়া প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। ছেলেরা ঢিল মারিয়া শিল্পীযুগলকে শিক্ষা দিয়াছে। বহু ফোনের পর পুলিশ এক বার দর্শন দিয়াছিল। তাহার পর, ছেলেরা পূর্ববত্ অসভ্যতায় মাতিল। কেহ যদি সন্দেহ করেন যে পুলিশের সহিত এই দুষ্কৃতীদের রফা হইয়া গিয়াছিল, এবং তাহা রাজনৈতিক রং মিলাইয়াই, আপত্তি করিবার উপায় থাকিবে না। অন্য দিকে, হাওড়ায় কয়েক জন তরুণীকে লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করায় শাসক দলের শাখা কার্যালয়ের সামনেই দুই যুবককে বেধড়ক প্রহার করিল কিছু দুষ্কৃতী, যাহারা প্রত্যেকেই শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হিসাবেই পরিচিত। পুলিশ গোড়ায় অভিযোগ গ্রহণ করিতেই অস্বীকার করে। পরে জানায়, অভিযুক্তরা পলাতক। শাসক দলের প্রতিপালিত অপরাধীদের আড়াল করিবার এই ছকটি এতই চেনা যে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
কালীক্ষেত্রের ইচ্ছাময়ীর পায়ের জবা হইয়া ফুটিতেই যে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের একমাত্র আগ্রহ, তাহা সুপ্রতিষ্ঠিত। নেত্রী তাহাই চাহিয়াছিলেন। তিনি আনুগত্য চাহেন। কোনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি নহে, কোনও শাসনব্যবস্থার প্রতি নহে, এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিটির প্রতিও নহে— তাঁহার কাম্য শুধু ব্যক্তিগত আনুগত্য। পুলিশ, প্রশাসন একেবারে নিবেদিতপ্রাণ সাধকের ভক্তিতে বঙ্গেশ্বরীর সেই চাহিদা মিটাইয়াছে। পুলিশ এখন শাসক দলের শাখা সংগঠন— সরকারি অর্থে প্রতিপালিত দলীয় কর্মী। বস্তুত, নিচু তলার কর্মী। পুরসভার কাউন্সিলরও যাহাদের ধমকাইতে পারেন। সেই নিচু তলার কর্মীরা দলের অন্যান্য (উর্দিহীন) কর্মীদের রক্ষা করিতে জান লড়াইয়া দিবে, তাহাতে সন্দেহ কী? এখন সম্ভবত আর নেতাদের আদেশেরও দরকার হয় না। দলীয় দুষ্কৃতীরা বিপাকে পড়িয়াছে দেখিলেই পুলিশ তাহাদের রক্ষা করিতে ছোটে। ইভান পাভলভ থাকিলে তাঁহার তত্ত্বে হয়তো নূতন উদাহরণ জুড়িতেন। পুলিশ প্রশাসনকে যে এমন ভাবে সম্পূর্ণ দখল করিয়া ফেলা যায়, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অধীশ্বররাও চৌত্রিশ বছরে সম্ভবত তাহা ভাবিয়া উঠিতে পারেন নাই। তাঁহাদের মহামহিম লোকাল কমিটিও তৃণমূল কংগ্রেসের পারদর্শিতার নিকট ম্লান হইয়া গিয়াছে।
নবান্নের মহানায়িকা যাহা চাহিয়াছিলেন, পাইয়াছেন। তাঁহার দলীয় দুষ্কৃতীরাও এই অভয়ারণ্যে সদাপট বিচরণ করিতেছে। কিন্তু, যাঁহারা এখনও সিন্ডিকেটে নাম লিখাইতে পারেন নাই, অথবা দলের মিছিলে ঘাড়ে পতাকা ফেলেন নাই, তাঁহাদের কী হইবে? ক্লায়েন্টেলিজম-এর চক্রের বাহিরে বাঁচিবার অধিকার বঙ্গেশ্বরী এই রাজ্যে রাখেন নাই। বাচিকশিল্পী-দম্পতি অথবা হাওড়ার দুই যুবক প্রত্যক্ষ ভাবে প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। তাঁহারা শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা দুষ্কৃতীদের বিরোধী, অতএব তৃণমূলের রাজনৈতিক পাটিগণিতে তাঁহারা শাসক দলের, অতএব বঙ্গেশ্বরীরও, বিরোধী। পুলিশ যে তাঁহাদেরই গ্রেফতার করে নাই, ইহাই সম্ভবত সৌভাগ্য হিসাবে বিবেচিত হইবে। কিন্তু, অধিকাংশ সাধারণ মানুষ যে ভঙ্গিতে বাঁচিতে চাহে, তেমন ভাবে সব অসুবিধা মুখ বুজিয়া সহিয়া, অন্যায় দেখিলে অন্য দিকে চোখ ফিরাইয়া থাকিয়াও কি এই রাজ্যে আর বাঁচা সম্ভব? শাসক দলের দুষ্কৃতী ভিন্ন পুলিশ অন্য কাহারও সাহায্য করিবে, এমন আশা কেহ আর দেখিতেছেন কি? নবান্নের নীচে এই অন্ধকারই পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যত্।