দৃশ্য ১: চতুর্থী। সন্ধে আটটা। যোধপুর পার্ক থেকে ৯৫ পল্লী যাওয়ার রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে আট-দশটি ছেলেমেয়ে। প্রত্যেকের হাতে ভেঁপু। একসঙ্গে তারস্বরে বাজাচ্ছে তারা। শব্দে কাঁপছে শান্ত পাড়াটা। পুজো এল।
দৃশ্য ২: সপ্তমী। সকাল সাড়ে ন’টা। দক্ষিণ কলকাতার বড় মণ্ডপ। স্মার্টফোনে প্রতিমার ছবি তুলতে ব্যস্ত এক অল্পবয়সি মেয়ে। হঠাৎ ক্যামেরার সামনে এক মাঝবয়সি চেহারা। ঝাঁঝিয়ে উঠল কন্যে, ‘কোত্থেকে যে আসে এরা! ননসেন্স।’ সক্কাল সক্কাল এ হেন অমৃতবচনে ভদ্রলোক স্তম্ভিত। পুজো চলছে।
দৃশ্য ৩: পঞ্চমী টু দশমী। রাত দেড়টা-দুটো-আড়াইটে-তিনটে... কলকাতা উত্তর টু দক্ষিণ। বিকট শব্দ আর হর্ষধ্বনি তুলে পাড়া দাপাচ্ছে বাইকবাহিনী। পুজোর রাত।
পুজো বাঁদরামির সামান্য কিছু নমুনা। আরও অজস্র আছে। থাকবেও। এগুলো ছাড়া শ্রেষ্ঠ উৎসবের মাত্র চারটে দিন পানসে মেরে যায় যে! সুতরাং সইয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। যেমন ফি-পুজোয় আমরা সয়ে আসছি অষ্টমীর অঞ্জলিতে প্রতিমার সামনের জায়গা দখলের গুঁতোগুঁতি, ঝুড়ির ফুল খাবলায় তুলে নেওয়ার কাড়াকাড়ি, জনজোয়ারে সামনে তিলমাত্র জায়গা নেই দেখেও প্রবল ঠেলাঠেলি। বাঙালির এই আনন্দযজ্ঞে নাকি সবার নিমন্ত্রণ! শিশু থেকে সুপ্রবীণ, সকলের শামিল হওয়ার কথা এই মহোত্সবে! কথাটা এখন একেবারে ভুল। নির্মম সত্যিটা হল, ঠাকুর দেখার প্রতিযোগিতায় নিজের গায়ে দুর্দান্ত বাহুবলী, পাক্কা ঝামেলাবাজ, গুঁতোনো-ঠেলা-কনুইয়ের গোঁত্তা মারায় এক্সপার্টদের ছদ্মবেশগুলো চাপিয়ে না নিলে এই বচ্ছরকার উন্মাদনায় আপনার কোনও স্থান নেই। আর যে তা পারবে না? কিংবা, অসুস্থ বা বয়স্ক বা বাচ্চারা? তাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য তো ঘরের টিউবলাইটটা আছে, ছাদ-বারান্দা আছে, নিউজ চ্যানেলে লাইভ পুজো আছে, ঘুরে-আসাদের রসিয়ে বলা গল্পও আছে। প্যান্ডালের পুজো তাদের জন্য নয়। শারদীয় কলকাতায় এখন একটা অদৃশ্য ব্যানার ঝোলে: পুজোর সময় দুর্বলদের এ শহর একদম ‘ওয়েলকাম’ করে না।
যে কোনও উৎসবই আনন্দের, হুল্লোড়েরও। একই সঙ্গে সেই উৎসব উপভোগেরও। সেটা প্রত্যেক মানুষের জন্যই সত্যি। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি স্বার্থপর পুজো মনে রাখেনি। কোনও বছরই রাখে না। যত দিন যাচ্ছে, এই স্বার্থপরতা ক্রমশই বাড়ছে, বাড়ছে বেপরোয়া উল্লাসের মাত্রা। এখানে একটাই নিয়ম: পুজো নির্ঘণ্টের এক মাস আগে থেকে শুরু হওয়া উন্মত্ততায় অংশী হও, আর তাল-কাটা’রা নিজের দায়িত্ব নিজেরাই নাও। পুজোর ক’দিন হঠাৎ ডাক্তার ডাকার দরকার হলে, হাসপাতালে পৌঁছতে হলে, ছেলেমেয়ে কাছে থাকতে না পারলে, নিকটাত্মীয়কে হারালে চার পাশে ক্রমশ ঘন হয়ে আসবে ঝামেলা, হেনস্তা আর নাকাল হওয়ার অধ্যায়গুলো। এ বছরই পঞ্চমীর দক্ষিণ কলকাতার যানজটের সাঁড়াশি চাপে আটকে থেকে দেখেছি, সামনের ট্যাক্সি থেকে নেমে দুটি ছেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগাল। হাতে দুই ঢাউস সুটকেস। আর সেই ছুটন্ত সুটকেসের গোঁত্তা খাওয়া এক যুবক একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, ‘আশ্চর্য! কেন যে এরা সময় হাতে নিয়ে বেরোয় না।’
সত্যি, আশ্চর্য! দোষটা তো সম্পূর্ণত ওই ছেলেদেরই। দোষ নয়, ভয়ংকর অপরাধ। তারা কেন জনজোয়ারে গা ভাসিয়ে নামকরা পুজো-প্যান্ডালের ঠেলাঠেলিতে হাত-পা না লাগিয়ে নিজের প্রয়োজন নিয়ে বেশি মেতেছিল? হাতে সময় নেই জেনেও কেন ‘প্যান্ডাল হপিং’-এ মত্ত পাবলিকের অসুবিধে ঘটিয়েছে? বরং রাতের ফ্লাইট বা ট্রেনে ওঠার জন্য তো সকাল ছ’টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেই হত। এদের শাস্তি পাওয়াই উচিত। শাস্তি, সময়মত গন্তব্যে না-পৌঁছনো, প্রচুর খরচ করেও বেড়াতে যাওয়ার পুরো প্ল্যানটা বানচাল হয়ে যাওয়া। যেমন, এগারো মাসের মেয়েকে নিয়ে পঞ্চমীর সন্ধেয় ভবানীপুরের ঠাকুর দেখতে বেরনোর মাশুল দিতে হয়েছে আমাদের। প্রচণ্ড গরমে চিৎকার করে কাঁদতে থাকা মেয়েকে কোলে নিয়ে জ্যামে স্তব্ধ রাসবিহারী থেকে আনোয়ার শাহ রোডের মোড় পর্যন্ত হেঁটে ফিরতে হয়েছে। স্বাভাবিক। দুধের শিশুকে ঠাকুর দেখানোটা এ শহরে বেয়াড়া আবদার বইকী। সুতরাং, চেনা-পরিচিত প্রত্যেকেরই আঙুল তাক করে আমাদের মতো নির্বোধ মা-বাবার দিকে। এ পুজো যে নির্লজ্জ ভাবে সক্ষম প্রাপ্তবয়স্কদের। পারলে লড়ো, না পারলে বেরিয়ে যাও, বাইরে থাকো।
মহালয়া পার হলেই তাই এখন ভয় করে। ফের একটা শক্তির, ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষায় বসতে হবে ভেবে। পুজোর উচ্ছ্বাস এ শহরের কাছে নতুন নয়। কিন্তু তার সম্পূর্ণ বেলাগাম হয়ে যাওয়াটা নতুন। ভিড়, হুল্লোড়, আনন্দের শরীর থেকে আচমকাই যেন ‘সভ্যতা’ শব্দটা খসে পড়ে গিয়েছে। অষ্টমী-নবমীর রাতে মানুষের যে স্বাভাবিক আনন্দমুখর স্রোত কলকাতার পুজোর ইউএসপি ছিল, হঠাৎই তার চেহারা দেখে ভয় লাগতে শুরু করেছে। রাত এগারোটার পর ঠাসাঠাসি ভিড়ে পাশ থেকে উড়ে আসা দিশি মদের গন্ধ, সদ্য-কিশোরদের জঘন্য চাউনি, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের ফাঁকা জায়গাটায় ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে থাকার সময় ছিটকে আসা কুৎসিত মন্তব্য, কোনওটাই কি পুজোর আমেজের সঙ্গে খাপ খায়? না কি শান্ত পাড়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ভেঁপুর উৎকট আওয়াজে আঁতকে ওঠার মধ্যে দিয়েই দেবীর আবাহন সম্পন্ন হয়?
কিন্তু এটাই এখন এ শহরের বাস্তব চেহারা। অন্যকে তিলমাত্র জায়গা ছেড়ে না-দেওয়ার, সম্মান না জানানোর, শোভন-অশোভনের গন্ডি ছাড়িয়ে যা-ইচ্ছে-তাই করার অতি-আধুনিক রেওয়াজ। তার ওপর উৎসবের আগমন মানে তো সেই টিমটিম করে জ্বলতে থাকা সামান্য কিছু মানবিক বোধগুলোকেও একেবারে ছুটির দরখাস্ত ধরিয়ে দিয়ে ষোলো আনা অসভ্যতার ঢালাও লাইসেন্স। এর পরে, রাত আটটায় ঠাকুর দেখতে আসা বৃদ্ধকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জান্তব ভিড় নিজের জায়গা আদায় করে নিলে সেটা খুব অস্বাভাবিক ঠেকে কি? ‘সর্বজনীন’ শব্দটাও তো বোধগুলোর সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যেতে বসেছে।
পঞ্চমীর সন্ধের দেশপ্রিয় পার্ক-কে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভেবে যাঁরা আগামী বছরের পুজোর আশ্বাস নিচ্ছেন, তাঁরা নেহাতই আশায় ভর করে বাঁচেন। এ চিত্র আসছে বছর আবার হবে। তার পরের বছর আবার। হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কোনও প্যান্ডালের বাইরে। আর আমরা চোখ বন্ধ করে পুজোর জোয়ারে বছর বছর ভাসব। চোখের সামনে লাগামছাড়া অসভ্যতা দেখেও পুজোর দোহাই দিয়ে বেকসুর ছাড়ান দেব আর প্রাণপণ প্যান্ডাল-প্রতিমা-আলোকসজ্জায় থিম খুঁজতে থাকব। লজ্জা, ঘেন্না পাওয়ার জন্য বাদবাকি দিনগুলো তো আস্তই রইল।