এক জন ব্যক্তি একটি বৎসরের অভিজ্ঞান হইয়া থাকিলেন, ইতিহাসে এমন ঘটনা সুলভ নহে। নরেন্দ্র মোদী সেই কৃতিত্বের অধিকারী হইয়াছেন। লোকসভা নির্বাচনে বহুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করিয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া তাঁহার প্রধান কৃতিত্ব নহে। তিনি ভারতের হতাশ্বাস সাধারণ মানুষকে সুশাসনের সম্ভাব্যতায় ফের বিশ্বাস করাইতে পারিয়াছেন, এবং নিজেকে সেই সুশাসনের নির্বিকল্প মুখ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছেন, ইহাই ২০১৪ সালের উপর তাঁহার দাবিকে প্রশ্নাতীত মান্যতা দিয়াছে। যদিও, তাঁহার শাসনের প্রথম ছয় মাসে বারংবার সন্দেহ হইতেছিল, তাঁহার সাফল্য বুঝি ফেরিওয়ালার সাফল্য: কথামাত্র সার। শেষবেলার তৎপরতা সেই সংশয়কে খানিক হইলেও দূর করিয়াছে। কয়লাখনি বণ্টন, বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের অনুপাত বৃদ্ধি এবং জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধনী, তিনটি অতি জরুরি প্রশ্নকে ভবিতব্যের হাতে ছাড়িয়া না দিয়া অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে তাহার ফয়সলা করিবার সিদ্ধান্ত সরকারি উদ্যোগের পরিচায়ক। ইউপিএ সরকারের যে নীতিপঙ্গুত্ব ভারতকে অন্ধকারে ঠেলিয়া দিয়াছিল, নরেন্দ্র মোদী তাহার বিপরীতগামী হইতে সচেষ্ট। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ যাহাতে শুধু অষ্টোত্তর শতনামে আরও একটি সংযোজন হিসাবেই থাকিয়া না যায়, ভারতে নির্মাণক্ষেত্রের কুশলতা যাহাতে বৃদ্ধি পায়, তাহা নিশ্চিত করিতে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সক্রিয়তাও একই কথা বলিতেছে। মানুষ তাঁহার প্রতি যে আস্থা প্রকাশ করিয়াছে, শিল্পমহল তাঁহাকে যে ভাবে বিশ্বাস করিয়াছে, নরেন্দ্র মোদী অবশেষে তাহার মর্যাদারক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করিলেন বলিয়া আশা করা চলে।
প্রশ্ন উঠিবে, তিনি সুশাসনের সহিত গণতান্ত্রিকতার বিচ্ছেদ ঘটাইতেছেন না তো? তাঁহার শাসনের মানসিকতা একনায়কতান্ত্রিক বলিয়াই কি তিনি সংসদীয় প্রক্রিয়ার পরিবর্তে অর্ডিন্যান্সে বিশ্বাসী? অগণতান্ত্রিক শাসনের কিছু চরিত্রলক্ষণ যে ফুটিয়া উঠিতেছে, তাহা অস্বীকার করিবার নহে। যেমন, মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক যে ভঙ্গিতে শিক্ষা জগৎকে শাসন করিতে উদ্যত, তাহাতে কপিল সিব্বলের উত্তরাধিকার প্রকট। পরিবেশের প্রশ্নেও সরকারের ভূমিকা প্রশ্নযোগ্য। গণতন্ত্র রক্ষার দায় শাসকের, সন্দেহ নাই। কিন্তু বিরোধীদের দায়িত্বও কম নহে। সংসদ অচল করিয়া গুরুতর প্রশ্নগুলিকে অমীমাংসিত ফেলিয়া রাখিবার মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা নাই, দেশের ভবিষ্যৎ বিষয়ে চিন্তারও ছাপ নাই। সরকারের সহিত অবিরত আলোচনা চালাইয়া যাওয়া, নিজেদের মতামতকে যুক্তিসঙ্গত ভঙ্গিতে প্রকাশ করা, বিকল্প নীতির সন্ধান দেওয়া বিরোধীদের কর্তব্য। তাঁহারা সেই দায়িত্ব পালনে এখনও অবধি ব্যর্থ। বৃহত্তর নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে। শুধু সমালোচনা নহে, সরকারের সহিত চিন্তার স্তরে আদানপ্রদান, সংযুক্তি জরুরি।
নরেন্দ্র মোদী ভারতকে যে পথে লইয়া যাইতে উদ্যত, সেখানে রাজ্যগুলির ভূমিকাও প্রচুর। এই বৎসর যোজনা কমিশন বিলুপ্ত হইয়াছে। রাজ্যের আর্থিক স্বাধীনতা বহুলাংশে বাড়িয়াছে। বাড়িয়াছে দায়িত্বও। জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধনীও রাজ্য সরকারগুলির হাতে বাড়তি ক্ষমতা তুলিয়া দিয়াছে। ইহা ১৯৯১-উত্তর নূতন জমানার চরিত্র আরও জোরদার করিতেছে: রাজ্যের উন্নয়ন আর শুধু কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী নহে, অতঃপর খোলা বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, দায়িত্বশীল রাজস্ব নীতির মাধ্যমে, এবং সর্বোপরি শাসকদের দূরদর্শিতার মাধ্যমে রাজ্যগুলি অগ্রসর হইবে। কোন রাজ্য কয় কদম আগাইবে, আর কোন রাজ্য তলাইয়া যাইবে হতাশার অন্ধকারে, তাহা বহুলাংশেই রাজ্য সরকারগুলির হাতে। কথাটি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনে গভীর আশঙ্কার ছায়া ফেলিবে। ২০১৪ সাল জুড়িয়া পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা যে পথে চলিয়াছেন, তাহাতে এই রাজ্যের জন্য থাকে শুধু অন্ধকার।