শনিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নূতন লড়াইয়ের জন্ম হইল। সদ্য-অভিষিক্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথগ্রহণের পর দিনই রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি-সহ গোটা দেশের বড়-ছোট-মাঝারি শহরে মানুষের ঢল বন্যার মতো নামিয়া আসিল— তাঁহারা প্রেসিডেন্টের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করিতে চাহেন। এই বিরাট-সংখ্যক প্রতিবাদী-মিছিলের শিরোভাগে মেয়েরা। স্বাভাবিক, কারণ প্রেসিডেন্ট হইবার আগেই ট্রাম্প বুঝাইয়া দিয়াছেন তিনি মহিলাদের সমমাপের বা সমমর্যাদার নাগরিক বলিয়া মনে করেন না। প্রতিবাদ-সমুদ্রে মিশিয়া গেলেন আরও অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষ, কেহ যৌন নির্বাচনের স্বাধীনতার দাবিতে, কেহ অভিবাসীদের স্বীকৃতির দাবিতে, কেহ বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষায়, কেহ-বা অধিকতর অর্থনৈতিক অধিকারের চাহিদায়। সব মিলাইয়া ছবিটি প্রথম দিনেই বুঝাইয়া দিল, আমেরিকা কত দ্বিখণ্ডিত, বিপন্ন। ইতিপূর্বে এত বড় মিছিল এ দেশে কবে ঘটিয়াছে, মনে করিতে রথীমহারথীরা মাথা চুলকাইলেন: স্বাভাবিক ভাবেই, কেননা উনিশশো ষাটের দশকে ভিয়েতনাম-যুদ্ধের বিরুদ্ধে শেষ বার জনতা যখন এ ভাবে রাস্তায় নামিয়া আসে, তখন ইঁহারা ছিলেন ক্ষুদ্র মানবক। অর্থাৎ একটি গোটা প্রজন্ম এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় নাই।
অভূতপূর্ব না হইলেও অনতিদৃষ্ট এই ঘটনা প্রমাণ করে, মার্কিন গণতন্ত্র কেবল ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিত্বকে প্রেসিডেন্ট পদে জিতাইয়া আনিতে পারে না, পাশাপাশি নির্বাচনে জয়ী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিশাল জন-অস্বীকৃতির প্রবাহও বহাইয়া দিতে পারে। সেই অর্থে গণতন্ত্রেরই উৎসব এই প্রতিবাদ আন্দোলন। কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, (ট্রাম্প নিজেই করিয়াছেন), এই প্রতিবাদ আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী, নির্বাচন তো হইয়া গিয়াছে, নির্বাচনের সময় কোথায় ছিলেন ইঁহারা। দুইটি ভাগে এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভব। প্রথমত, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইবার সুবাদে চার বৎসর ক্ষমতাশীর্ষে থাকিবেন বলিয়াই চার বৎসর মুখ বুজিয়া থাকা জনগণের কর্তব্য হইতে পারে না। প্রতিবাদের অধিকার যদি মান্য হয়, তাহা হইলে প্রথম দিনের প্রতিবাদেও আপত্তি থাকিতে পারে না। প্রেসিডেন্ট নিজের কাজ করুন, প্রতিবাদীরা তাঁহাদের। প্রতিবাদের দাপট প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করিবে কি না, তাহা অবশ্যই তাঁহার বিবেচনা। দ্বিতীয়ত, ভোটে প্রতিবাদীরা কে অংশ লইয়াছেন, কে লন নাই, ভোট-পরবর্তী রাজনৈতিক বিরোধিতায় অংশগ্রহণের অধিকার তদ্দ্বারা অস্বীকৃত হয় না।
পরের প্রশ্ন, চার বৎসর এই প্রতিবাদীরা কী করিবেন। যত অসমর্থনই প্রকাশ করুন না কেন, অপেক্ষা ছাড়া তাঁহাদের সামনে কোনও পথ নাই। সেই কারণেই প্রতিবাদ জারি রাখিলেও তাহা শান্তিপূর্ণ রাখা একটি প্রধান শর্ত। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের পরিসর খোলা রাখিতে হইলে হিংসা সর্বত পরিত্যাজ্য। শনিবারের গণমিছিলে কিন্তু সেই শর্ত মোটের উপর রক্ষিত হইয়াছে। বহু প্রতিবাদীর মুখে ধ্বনিত হইয়াছে প্রাথমিক সুবিবেচনার কথা যে— একটিও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিলে ক্ষমতাসীন প্রতিপক্ষ চার বৎসর ধরিয়া তাঁহাদের বিঁধিবার উপলক্ষ পাইবে, সুতরাং, শান্তিপূর্ণ পথের বিকল্প নাই। এই বিবেচনাপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল কেবল আমেরিকাকেই নয়, অবশিষ্ট দুনিয়াকেও পথ দেখাইবার মতো। বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচার কিংবা অসহিষ্ণু ক্ষমতার রাজনৈতিক উত্থানকে কী ভাবে প্রতিহত করা যায়, তাহার দিশার সন্ধান। অধিকাংশ দেশেই এখন গণতন্ত্র বলিতে কেবল ভোট বোঝানো হয়, ভোট-পরবর্তী রাজনীতিতে মানুষের ভূমিকা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। আমেরিকা মনে করাইয়া দিল, গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের অধিকার নয়, নির্বাচিতকে প্রশ্নযোগ্য করিয়া রাখিবার অধিকারও বটে।